বুদ্ধের পুতাস্থি: রাখা রয়েছে কলকাতাতেই
হিউয়েন সাঙ তাঁর ভ্রমণ-বিবরণে বুদ্ধের বঙ্গভূমি পরিভ্রমণের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, তিনি সমতটের যে স্থানে সাতদিন থেকে ধর্ম প্রচার করেছিলেন, মগধের রাজা অশোক সে স্থানে একটি স্তূপ বানিয়েছিলেন। স্তূপটি তিনি দেখেওছিলেন। কিন্তু বাঙালির ইতিহাস সন্ধান করতে গিয়ে ড. নীহাররঞ্জন রায় এই বিষয়ের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছিলেন বুদ্ধদেব পূর্বদিকে দক্ষিণ বিহারের সীমা অতিক্রম করেছিলেন বলে কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই। তাই বলে বাঙালির বৌদ্ধ হওয়া আটকায়নি। অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, নর্ডিক, মঙ্গোলীয়—নৃতত্ত্বের এই মহা সম্মিলনে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতির আদি ধর্ম হিসেবে বৌদ্ধ ধর্মের উল্লেখ, বিকাশ এবং বিস্তারের সূত্রগুলো আজ হয়তো অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছে, কিন্তু বাংলা এবং বাঙালির সঙ্গে বুদ্ধের যোগ, বৌদ্ধ ধর্মের যোগ কখনোই মুছে যায়নি।
নিজের উৎসকে ফিরে দেখতে গিয়ে বাঙালি বারবার ইতিহাসের যে পাতায় ফিরে এসেছে সেখানে লেখা রয়েছে ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’-র বীজমন্ত্র। সাহিত্যের পাতাতেও সেই সুর, সহজিয়া বৌদ্ধ সাধকদের লেখা চর্যাপদের উপর বাঙালিরই একান্ত অধিকার। বাঙালি এককালে বৌদ্ধ ছিল। কিন্তু গঙ্গা দিয়ে তারপর বয়ে গেছে অনেক জল। কোণঠাসা করতে করতে বৌদ্ধ ধর্মকে ঘাড় ধরে সীমান্ত পার করিয়ে দেওয়া হয়েছে ইতিহাসেরই পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে। বাংলার সংস্কৃতিতে এসে মিশেছে ইসলাম, রুখে দাঁড়ানোর নামে তীব্র হয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদ—ঘাত আর প্রতিঘাতের এই পথ চলায়, উনিশ শতকের নবজাগরণে বাঙালি প্রশ্ন করেছে ধর্মের নিয়মকে, ধর্মের নীতিকে— নিজের ছাঁচে, নিজের মতো করে গড়তে চেয়েছে নতুনকালের ধর্মমত। সনাতন হিন্দুধর্ম হোক কিংবা নতুনকালের ব্রাহ্ম, বৈষ্ণবরাও পুনরুজ্জীবিত হয়েছে উনিশ শতকের শেষভাগে এসে। অনেকেই হয়তো জানেন না, ঠিক যে সময়ে রামকৃষ্ণ-বিবেকাননন্দের হাত ধরে পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে হিন্দুধর্ম, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীদের হাতে পুনঃরুজ্জিবীত হচ্ছে বাংলার বৈষ্ণবসমাজ ঠিক সেইসময়েই এই কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে বাঙালির আদি ধর্ম তথা এককালের ভারতবর্ষের রাজধর্ম বৌদ্ধ ধর্মও উঠে আসছিল মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা অন্ধকূপ থেকে, বৌদ্ধ পুনরুজ্জীবনের সেই গল্প কোনও রহস্য রোমাঞ্চের অনুসদ্ধানের চেয়ে কিছু কম নয়।
এই গল্পের প্রথম পটভূমি নর্থ ওয়েস্ট প্রভিন্স অ্যান্ড আওধ, ব্রিটিশ রাজ, উত্তরপ্রদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ঘেঁসে নেপাল বর্ডার সংলগ্ন এলাকা। পাহাড় আর জঙ্গলের হাত ধরাধরি করা এক রোমাঞ্চময় পরিবেশ। জঙ্গল। আদিম অরণ্যের বুকে ডুবে থাকা ইতিহাস রহস্যের খোঁজ কেইই বা জানত সেখানে। জানতেন না উইলিয়াম ক্ল্যাক্সটন প্যেপে-ও। যিনি পারিবারিক সূত্রে সেই পার্বত্যজঙ্গলের মধ্যে পেয়েছিলেন একটি প্রাসদোপম বাড়ি আর জমিদারি। খাতায় কলমে নাম বার্ডপুর zaমিনদারি। মি. ক্ল্যাক্সটনের বাংলো থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ মাইল উত্তরে, নেপাল সীমান্তের মাত্র আধ-মাইল আগে রয়েছে পিপুল অর্থাৎ অশ্বত্থ গাছে ঘেরা ঘন জঙ্গল। তারই মাঝে পিপরাহ্ওয়া গ্রাম। জঙ্গলের ভিতরে এদিক-ওদিক ছড়ানো রয়েছে কিছু পাথুরে ঢিবি। ঢিবিগুলোকে স্থানীয় লোকজন কোনো পুরনো দুর্গের ধ্বাংসাবশেষ বলেই জানে, কিন্তু একদিন শিকারে গিয়ে টনক নড়ল ক্ল্যাক্সটন সাহেবের। কীসের ঢিবি এগুলি? এখানে কি গুপ্তধন রয়েছে? লোক-লস্কর জুটিয়ে শুরু হল খোঁড়াখুঁড়ি। ১৮৯৭ সালের ঘটনা এটি। কয়েক সপ্তাহ তো লেগে গেল মাটি, পাথর, ঝোপঝাড় সরাতেই। তারপর মিলল একশো কুড়ি ফুট ব্যাসযুক্ত একটি অর্ধগোলক গম্বুজ ধরণের নির্মাণের। শুরু হল গম্বুজের ওপর থেকে কুয়োর মতো খুঁড়ে নিচে নামার প্রক্রিয়া। ফুট দশেক খোঁড়া হতেই, চোখ মুখ উজ্ব্বল হয়ে উঠল সকলের, “সোনা, সোনা…” জঙ্গলের রব পৌঁছালো সাহেবের কানে। সাহেব বুঝলেন আরও খুঁড়লে আরও মিলবে।
অতঃপর খনন জারি রইল, বছর গড়িয়ে সবে নতুন বছর এসেছে। শীতের বিকেলের আলো তখন পড়ে আসছে জঙ্গলের মাথায়। খবর গেল সাহেবের কাছে। খুঁড়তে খুঁড়তে একেবারে নিচে পৌঁছে গেছে খননকারী দল। ইটের ভিতের উপর সেখানে রয়েছে একটি বড়োসড় বেলেপাথরের সিন্দুক। সিন্দুক মানেই গয়না, নয়তো মোহর। গুপ্তধনের আশায় সাহেব তো ছুটলেন ঘোড়ার পিঠে। কিন্তু অতো বড়ো আর ভারী একখানা বাক্স মাটির অতো নীচ থেকে এই সরু কুয়োর মতো গম্বুজের মুখ দিয়ে ওপরে তুলে আনা চাট্টিখানি কথা নয়। ঝাড়া তিনদিন লেগে গেল সে বাক্স টেনে তুলতে। বাক্স খুলতেই তো উল্লাস। নানা আকারের নানা রকম পাত্র, আর পাত্রের ঢাকনা খুলতেই দামী দামী পাথর, সোনা আর রুপোর গয়না। উল্লাস শেষ হলে সাহেব দেখলেন, বিশাল সেই বাক্সে রয়েছে আরও কিছু কাঠের বাক্স, এতদিন মাটির তলায় থেকে সেগুলির অবস্থা খুবই খারাপ। কিন্তু খুলতেই শিহরণ খেলে যাওয়া চমক! বাক্সে রয়েছে কোন মৃত মানুষের হাড় ও দেহভস্ম।
মিশরে মমির আবিষ্কারের রোমাঞ্চকর গল্পকেও হার মানায় এই গল্প। এ কার মৃত্যু পরবর্তী সম্পত্তি তুলে আনালেন সাহেব? আত্মার অভিশাপ এবার লাগল বলে! সাহেব কিন্তু দমলেন না। চিঠি লিখলেন গোরক্ষপুরের জেলা জজ ভিনসেন্ট স্মিথ ও আরকিওলজিক্যাল সার্ভের লখনউ মিউজিয়ামের কিউরেটর আন্টন অ্যালয়েস ফ্যুরার-কে। তাঁরা ক্ল্যাক্সটনকে উপদেশ দিলেন খুঁজে পেতে দেখতে যে, কোথাও কোনও লিপি রয়েছে কিনা, থাকলে তার অনুলিপি করে পাঠাতে। উদ্দেশ পাঠোদ্ধার করা। একটি পাত্রের উপরে এমনই কিছু লিপি খুঁজে পাওয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার যথাসম্ভব অনুলিপি করে সাহেব পাঠালেন। সেই লিপির পাঠোদ্ধার করে ভিনসেন্ট স্মিথ ও কিউরেটর আন্টন ফ্যুরার-তো চমকে উঠলেন, এ যে স্বয়ং গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষ! অন্তত লিপিতে তো তাইই দাবি করা হয়েছে।
কিন্তু উদ্ধার হওয়া পুতাস্থি কি সত্যিই বুদ্ধদেবের? নিঃসংশয় হওয়ার বৈজ্ঞানিক কোনো উপায় নেই। কিন্তু বুদ্ধের দেহাবশেষ, ব্যবহৃত সামগ্রী আর মূর্তিকে অবলম্বন করে চৈত্য, স্তূপ আর বিহারে একসময় ভারতবর্ষের মানচিত্রে যে ছেয়ে গিয়েছিল, উনিশ আর বিশ শতকে আরকিওলজি বিভাগের এইরকম নানা কর্মকাণ্ডে তারই পুনরুদ্ধার ঘটে চলেছিল সমগ্র দেশজুড়ে। কিন্তু ইতিহাসের এই মাটি চাপা স্তূপ চৈত্য আর বিহারের আগুন ছুঁয়ে বুদ্ধের বাণীকে দিকে দিকে আবারও ছড়িয়ে দেওয়ার সংকল্পটি প্রথম যিনি করেছিলেন তিনি ছিলেন বাঙালি, ধর্মবিশ্বাসে বৌদ্ধ, চট্টগ্রামের কৃপাশরণ। বৌদ্ধ ভিক্ষুব্রতে দীক্ষিত হওয়ার পর যার নাম হয়েছিল ‘চন্দ্রজ্যোতি’। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে সুদূর চট্টগ্রাম থেকে কলকাতার বউবাজার অঞ্চলে এসেছিলেন কৃপাশরণ। উঠেছিলেন বউবাজারের কাছে এক পুরনো ভাঙা বাড়িতে। শুরু করেছিলেন নিজের পূর্বপুরুষের ধর্মকে পুনঃস্থাপনের এক অসম একাকী লড়াই। কেউ পাশে নেই, নেই কোনো সরকারি সাহায্যও, তবু নিজের চেষ্টায় গড়ে তুললেন বেঙ্গল বুদ্ধিস্ট অ্যাসোসিয়েশন। কৃপাশরণের এই লড়াই অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়ে শেষপর্যন্ত এই কলকাতার বুকে, বউবাজারের কাপালীটোলায় ললিতমোহন দাশ লেনে রূপ নিয়েছিল বৌদ্ধ বিহার ও মন্দির হিসেবে। মহানগরীর বুকের প্রথম বাঙালি বৌদ্ধক্ষেত্র ছিল এটিই। সিকিম থেকে নেপাল, কাশ্মীর থেকে গোরক্ষপুর— অর্থ সংগ্রহের জন্য ছুটে বেড়িয়েছিলেন কৃপাশরণ। ললিতমোহন দাশ লেনে পাঁচ কাঠা জমির উপর গড়ে ওঠা এই বুদ্ধ মন্দিরের বর্তমান ঠিকানা ১ নম্বর বুদ্ধিস্ট টেম্পল স্ট্রিট, মন্দিরের নামেই বদলে যায় রাস্তার নামটিও।
একদিকে পুরাতত্ত্বের আবিষ্কার অন্যদিকে ইতিহাসকে ফিরে দেখার সারস্বত আয়োজন—কৃপাশরণের উদ্যোগে সামিল হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালও। তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় চালু করলেন পালি ভাষা-সাহিত্য ও বৌদ্ধ দর্শন চর্চার বিভাগ। বেনীমাধব বড়ুয়ার হাত ধরে যে বিভাগ অর্জন করেছিল বিশ্বখ্যাতি।
কিন্তু কথা শুরু করেছিলাম বুদ্ধের পুতাস্থি নিয়ে। সেই কথায় ফিরে আসি আবার। ক্ল্যাক্সটন প্যেপের মতোই রাওয়ালপিণ্ডির কাছে তক্ষশিলায় বুদ্ধের দেহাবশেষ আবিষ্কার করেছিলেন পুরাতত্ত্ববিদ্ ক্যানিংহাম। ব্রিটিশ সরকারের কাছে তখন সেই ভস্মভাণ্ড এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। স্বভাবতই কৃপাশরণের মতো বৌদ্ধ পুরুত্থানবাদীরা সরকারি বিভাগে তদ্বির করলেন, বললেন এই পুতাস্থি সংরক্ষণ করতে দেওয়া হোক বৌদ্ধ বিহারগুলিকে, হাজার হাজার বৌদ্ধ ভক্ত তবে ছুঁতে পারবে ভগবান বুদ্ধের এই পবিত্র দেহাবশেষ। বাংলার গভর্নর তখন ছিলেন লর্ড কারমাইকেল। কৃপাশরণের কার্যকলাপের সঙ্গে তাঁর ভালোই পরিচয় ছিল। তিনি চেয়েছিলেন কৃপাশরণের হাতেই সংরক্ষিত হোক সেই পবিত্র পুতাস্থি। কলকাতাতেই নির্মিত হোক একটি পৃথক স্তূপ। উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। স্তূপের জন্য জমি দান করেছিলেন কাশিমবাজারের রাজা মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী। কিন্তু কৃপাশরণের মৃত্যু হওয়ায় সমগ্র পরিকল্পনাটি থেমে যায়।
আর তখনই এগিয়ে আসেন বৌদ্ধ পুরুত্থানের আরেক অবিসংবাদী নেতা অনাগরিক ধর্মপাল। জন্মসূত্রে সিংহল বা শ্রীলঙ্কার অধিবাসী হলেও কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করেই ছিল তাঁর কর্মজীবন। ১৮৯৩-এ শিকাগোর ধর্মসম্মেলনে তিনিই ছিলেন বিবেকাননন্দের সঙ্গী, বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। তার কর্মক্ষেত্র কলেজ স্কোয়ারের প্রান্তে চারের (৪) এ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে ‘মহাবোধি সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’র হলুদ রঙের বাড়িটি। হয়তো অনেকেই দেখে থাকবেন বাড়িটি। কিন্তু হয়তো অনেকেই জানেন না এই বাড়িতেই সংরক্ষিত রয়েছে ভগবান বুদ্ধের পবিত্র দেহাবশেষ।
আঠারো শতকের শেষ দশক, অনাগরিক ধর্মপাল তখন ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা হারিয়ে যাওয়া বৌদ্ধ ক্ষেত্রগুলির সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সদ্য আবিস্কৃত পুরাতত্ত্ব খেত্রগুলিতে দাঁড়িয়ে তিনি দেখছেন কীভাবে ধ্বংসের অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছে বুদ্ধের স্মৃতি। অশোকের মতো সম্রাট, একদিন যিনি ছিলেন ভারত সম্রাট, তাঁর অমর কীর্তিগুলিও ধূলিসাৎ হয়েছে সময়ের অন্তরালে। বোধিবিহার আর সারনাথের দুর্দশা ব্যথিত করল ধর্মপালকে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন বৌদ্ধধর্মের পুরুজ্জীবন ঘটিয়ে সারা বিশ্বে তাকে আবার ছড়িয়ে দেবেন। এই প্রতিজ্ঞাই জন্ম দিল মহাবোধি সোসাইটির, ১৮৯১-এ কলকাতায় যার গোড়াপত্তন। যে বাড়িটির কথা বললাম সেখানে এখন যে মন্দির রয়েছে তা অবশ্য তখনই তৈরি হয়নি। ১৯১৫ সালে মহাবোধি সোসাইটি রেজিস্ট্রিকৃত হওয়ার পরে ১৯১৮ সাল থেকে শুরু হয় মন্দির নির্মাণ। তাঁর আগেই অবশ্য তৎকালীন ভারতের শিক্ষাসচিব জন মার্শালের উদ্যোগে স্থির হয়ে গিয়েছিল, নতুন যে মন্দির তৈরি হবে তাতেই সংরক্ষিত থাকবে আবিস্কৃত হওয়া বুদ্ধদেবের পুতাস্থির কিয়দাংশ।
অনাগরিক ধর্মপালের উদ্যোগে কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি সদাচরণ মিত্রের সভাপতিত্বে গঠন করা হয়েছিল একটি কিমিটি, গঠন করা হয়েছিল ১ লক্ষ টাকার তহবিল। ধর্মপালকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন থিয়োসফিক্যাল সোসাইটির প্রাণপুরুষ হীরেন্দ্রনাথ দত্ত। কলেজ স্কোয়ারের পাশের জমিটি তাঁরই মধ্যস্থতায় হাতে পায় মহাবোধি সোসাইটি। শুরু হয় মন্দির নির্মাণ, অজন্তার ধাঁচে এর নকশা করেন জন মার্শাল। স্থাপত্যবিদ্ হিসেবে বিনা পারিশ্রমিকে কাজের তদারকি করেন বিখ্যাত ইঞ্চিনিয়ার শ্রী এম গাঙ্গুলি, যিনি বিখ্যাত Orissan Architecture বইটি লিখেছিলেন। ১৯১৮ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। প্রায় ২ বছর লাগে নির্মাণকাজ শেষ হতে। অবশেষে আসে সেই দিন, ২০ শে নভেম্বর ১৯২০।
সেদিন সকালে মহাবোধি সোসাইটির সভাপতি হিসেবে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় রাজভবনে গিয়ে ছোটোলাটের হাত থেকে গ্রহণ করেন পবিত্র পুতাস্থির পাত্রটি। রাজভবন থেকেই শুরু হয় শোভাযাত্রা। আজ থেকে একশো বছর আগে সেদিনের কলকাতায় সে ছিল এক অভূতপূর্ব শোভাযাত্রা, বুদ্ধের দেহাবশেষ, পবিত্র অস্থিভস্ম মাথায় নিয়ে সেদিনের সেই মিছিলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।
সাহিতিক বনফুল ছিলেন সেই শোভাযাত্রার প্রত্যক্ষদর্শী, তিনি লিখেছিলেন, “যোগদানকারীদের বেশিরভাগ ছাত্র অধ্যাপক। পুরোভাগে নগ্নগাত্র নগ্ন পদে আশুতোষ। তাঁর মস্তকে একটি পাত্র। তার ভিতর ভগবান বুদ্ধের দেহাবসানের স্মারক। সেই পবিত্র বস্তুকে তিনি কলেজ স্কোয়ারে অবস্থিত মহাবোধি সোসাইটিতে স্থাপন করেন।”
আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেই সেদিনের মিছিলে ছিলেন অনাগরিক ধর্মপাল, অ্যানি বেসান্ত প্রমুখ অনেক মানুষ। আশুতোষ কলেজের দেওয়ালে টাঙানো একটি তৈলচিত্রে আজও ধরা আছে সেদিনের ছবি।
অনেক ইতিহাসের সাক্ষী কলেজ স্কোয়ারের গোলদীঘি, আর তারই পারে সংরক্ষিত রয়েছে বুদ্ধদেবের পবিত্র পুতাস্থি। মহাবোধি সোসাইটির তত্ত্বাবধানে স্থাপিত এই মন্দিরের নীচের তলায় রয়েছে একটি বড়ো সভাগৃহ। মন্দিরের বেদীর পিছনে একটি নিটোল কালো মার্বেল পাথরের পাত্রে রাখা রয়েছে সেই পবিত্র পুতাস্থি। বৌদ্ধদের ভাষায় এই স্থানকে তাই বলা হয় ‘চৈত্য’ অর্থাৎ যেখানে বুদ্ধদেব আছেন। বৌদ্ধদের ‘চৈত্য’ হয় তিন প্রকার— ‘শারীরিক’— যেখানে বুদ্ধের দেহাংশ রয়েছে, ‘পারিভোগিক’— যেখানে বুদ্ধ ভোগ বা ব্যবহার করেছেন এমন কোনো বস্তু রক্ষিত আছে, আর ‘উদ্দেশিক’— যেখানে রয়েছে বুদ্ধের মূর্তি। মহাবোধি সোসাইটির এই ‘ধর্মরাজিকা চৈত্য বিহার’ হিসেব মতো প্রথম বর্গের। তবে পুতাস্থি ছাড়াও এখানে রয়েছে অপূর্ব সুন্দর কিছু বুদ্ধ মূর্তিও। মন্দিরের বেদিতে রয়েছে সোনালি রঙের একটি বুদ্ধ মূর্তি। আরেকটি বুদ্ধ মূর্তি আছে কাঁচের পাত্রে রাখা। এটি দিয়েছিলেন জাপানের সম্রাট হিরোহিতা। মন্দির আর চৈত্য ছাড়াও এখানে রয়েছে দুর্লভ কিছু বৌদ্ধ পুঁথির পাণ্ডুলিপি, সংশ্লিষ্ট গ্রন্থাগারে সেগুলি রাখা থাকে।
বাঙালি তার আদি ধর্মকে হয়তো ভুলেছে, হয়তো ভুলেছে চর্যার সাধন-ভজন, কিন্তু ইতিহাসের পাতা উল্টে চর্যাপদের সেইসব কবিতার মধ্যেই বাংলা ভাষার আদিম উচ্চারণে ধ্বনিত হয় বাঙালির আত্মপরিচয়। বাঙালির বৌদ্ধ ধর্ম—ইতিহাসের অনেক সমীকরণে হয়েছে ওলট-পালট, কিন্তু শহর কলকাতা আজও বুকে ধরে আছে সিদ্ধার্থের স্মৃতি, বোধি পুরুষের দেহচিহ্ন।
সানু ঘোষ, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা
১৬/০৫/২০২২
কিছু রেফারেন্স পাওয়া গেলে জানাবেন
উত্তরমুছুনঅবশ্যই জানাব, অনেক ধন্যবাদ
উত্তরমুছুন