শিক্ষক দিবস, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের নকল ও এক হতভাগ্য বাঙালি

 

১৯৯৫ সালে UNESCO-র ঘোষণায় আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করা হয় ৫ই অক্টোবর দিনটিকে। ভারতবর্ষে যদিও এই দিনের পরিবর্তে ৫ই সেপ্টেম্বরকে বেছে নেওয়া হয়েছে শিক্ষক দিবসের দিন হিসেবে, উপলক্ষ্য ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের জন্মদিন। ভারতবর্ষে ১৯৬২ সালে এই দিনটি শিক্ষক দিবসের মর্যাদা পায়। ওই বছরেই রাধাকৃষ্ণান হন ভারতের রাষ্ট্রপতি। গুরুপূর্ণিমার দিনে শিক্ষাগুরুকে সম্মান প্রদর্শনের রীতি যদিও ভারতীয় সংস্কৃতিতে বহু প্রাচীন কিন্তু আজ সে আলোচনা থাক; আচ্ছা যেই মানুষটির জন্মদিন শিক্ষকদের সম্মান প্রদর্শনের মধ্যে দিয়ে আমরা পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করি, হঠাৎ যদি জানতে পারি তিনিই তাঁর ছাত্রতুল্য এক গবেষকের গবেষণা থেকে হুবহু নকল করে বই লিখেছিলেন! আমাদের গড়ে তোলা শ্রদ্ধার জগতে কি সামান্য চিড় ধরবে তাহলে? ধরা পড়ে যাওয়ার পর বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও প্লেজিয়ারিজমের দায়ে তাঁকে আদালতের কাঠগড়ায় উঠতে হয়! অবাক লাগছে? ভাবছেন এও কি সম্ভব? অথচ ঠিক এমনটাই ঘটেছিল আজ থেকে অনেক বছর আগে। ভারত তখনও স্বাধীন হয়নি।


১৯২৯ সাল। মিরাট কলেজের দর্শনের অধ্যাপক যদুনাথ সিংহ এই অভিযোগ আনেন রাধাকৃষ্ণানের বিরুদ্ধে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যদুনাথ ইন্ডিয়ান সাইকোলজি অব পারসেপশন নামক এক বিরাট গবেষণা প্রকল্প জমা দেন। প্রাথমিকভাবে এই গবেষণা নিরীক্ষণের দায়িত্ব ছিল আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল ও সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের উপর। যদুনাথের সম্পূর্ণ গবেষণা শেষ হয় ১৯২৫ সালে। ১৯২৭ সালে রাধাকৃষ্ণানের ইন্ডিয়ান ফিলজফি-র দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ পায়‌। বিষয়টি যদুনাথ খেয়াল করেন ১৯২৮-এ যখন রাধাকৃষ্ণানের আরেকটি বই দ্য বেদান্ত অ্যাকর্ডিং টু শংকর অ্যান্ড রামানুজ প্রকাশিত হয়। যদুনাথ আবিষ্কার করেন, তাঁর গবেষণার প্রথম দুটি অধ্যায় থেকে যাকে বলে Copy-Paste করেছেন রাধাকৃষ্ণান!


১৯২৮-এর ২০শে ডিসেম্বর মর্ডান রিভিউ পত্রিকায় যে চিঠিটি যদুনাথ পাঠান, তা ১৯২৯-এর জানুয়ারিতে প্রকাশ পায়। তারপর যথাক্রমে ফেব্রুয়ারি-মার্চ-এপ্রিল, প্রকাশিত হয় আরও চিঠি। অবশ্য এর মধ্যেই ঘটে গেছে অন্য আরেকটি ঘটনা‌; রাধাকৃষ্ণানের বই প্রকাশ পাওয়ার আগেই নিজের গবেষণা থেকে কয়েকটি প্রবন্ধ মিরাট কলেজের পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন যদুনাথ। সম্ভবত এই সংবাদ রাধাকৃষ্ণানের জানা ছিল না। 


এর বিরুদ্ধে পাল্টা চিঠি লেখেন রাধাকৃষ্ণান, যদিও তা ধোপে টেকে না। তিনি যে পারিভাষিক শব্দ এক হয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ তুলেছিলেন, বাস্তব ছিল ঠিক তার উল্টো। যদুনাথের বিরুদ্ধেই রাধাকৃষ্ণান প্লেজিয়ারিজমের অভিযোগ এনে বলেন, তাঁরই বক্তৃতা ও নানা ভাষণ থেকেই নাকি যদুনাথ সূত্র চুরি করেছেন, অথচ যদুনাথ আদতে সরাসরি রাধাকৃষ্ণানের ছাত্রই ছিলেন না! তিনি এমএ পাশ করেন ১৯১৭-তে আর তখনও রাধাকৃষ্ণান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই আসেননি। যখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন, যদুনাথ তখন ঢাকায়। তাছাড়া যদুনাথের গবেষণা প্রকল্পের পরীক্ষক তো ছিলেন রাধাকৃষ্ণান স্বয়ং, তখন তিনি কোনো সূত্র চুরির প্রশ্ন তোলেননি কেন? 


মডার্ন রিভিউ-র তৎকালীন সম্পাদক ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। সেই সময় এক সুদীর্ঘ সম্পাদকীয়ও লিখেছিলেন তিনি এই বিষয়ে। ১৯২৯-র অগাষ্ট মাসে স্বত্বাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে, কলকাতার উচ্চ ন্যায়ালয়ে যদুনাথ রাধাকৃষ্ণানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন এবং ক্ষতিপূরণ বাবদ কুড়িহাজার টাকা চান। বসুমতী, দ্য হিন্দুস্থান টাইমস, বঙ্গবাণী প্রভৃতি সংবাদপত্র থেকে জানা যায়: যদুনাথ চেয়েছিলেন নকল করা অংশগুলিকে বাদ দিয়ে নতুন করে বই ছাপা হোক বা তাঁকে উপযুক্ত স্বীকৃতি প্রদান করা হোক। রাধাকৃষ্ণান এর বিরুদ্ধে পাল্টা মানহানির মামলা করেন, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ও মামলার হাত থেকে রেহাই পান না। একলক্ষ টাকা দাবি করেন ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান! আচ্ছা, এতদিন পরে কেন মামলা করলেন তিনি? আগেই করা উচিত ছিল না কি? মডার্ন রিভিউ তো তাঁর চিঠিও প্রকাশ করেছিল, তাহলে?


শেষপর্যন্ত সুবিচার পাননি যদুনাথ। রাধাকৃষ্ণানের খ্যাতি-প্রতিপত্তি-যশ-ক্ষমতার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে রাজি হননি কেউই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষও বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে চাননি, উল্টে যদুনাথ সিংহের উপরেই নানারকম চাপ সৃষ্টি করা হতে থাকে। এই মামলা চলে ১৯৩৩-র মে মাস পর্যন্ত। যদুনাথের পক্ষে এই মামলার আর্থিক ব্যয়ভার বহন করা সম্ভবপর ছিল না। হঠাৎই এই মামলায় হস্তক্ষেপ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য, রাধাকৃষ্ণানের বিশেষ বন্ধু শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তাঁর হস্তক্ষেপেই মামলাটি মিটিয়ে নেওয়ার সুপারিশ দেওয়া হয়, চিফ জাস্টিস ফণীভূষণ চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে। ডিক্রির শর্তগুলি কিন্তু আজও জানা যায় না‌। যদুনাথ যদি দোষী ও মিথ্যেবাদী হবেন, তাহলে বারবার তাঁর উপর মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয় কেন? ইন্ডিয়ান ফিলোজফি রাধাকৃষ্ণানের এক সম্মানীয় কাজ যার জন্য তিনি অজস্র স্বীকৃতি পান, সেখানে কে এই যদুনাথ সিংহ! তিনি এক হতভাগ্য বাঙালি, যিনি ছিলেন একাধারে ধর্মতাত্ত্বিক, লেখক, দার্শনিক। বেদান্ত, শক্তিসাধনা, বৈষ্ণব তত্ত্ব, মনস্তত্ত্বের মতো একাধিক বিষয়ে যাঁর গবেষণা এ দেশের মননকে ঋদ্ধ করেছিল। ফিলিপ স্যামুয়েল স্মিথ, ক্লিন্ট স্মৃতি পুরস্কার, গ্রিফিথ পুরস্কার, মোয়াট মেডেলের মতো একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জন করেছিলেন এই মানুষটি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেবল প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তিই পাননি (এই বৃত্তির জন্যই তাঁর গবেষণাটি পাঠিয়েছিলেন), ১৯৩৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে পিএইচডি প্রদানও করে। 


বর্তমানে ভুয়ো ডিগ্রি অর্জন, গবেষণাপত্র নকল করা, অন্যের গল্প-প্রবন্ধ স্বনামে ছেপে দেওয়ার মতো ঘটনার একাধিক উদাহরণ আকছার ঘটে। এইসব শুনে-পড়ে-দেখে মনে হয়না, সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে, কোথাও তার পরিবর্তন নেই?


_________________


বিতান দে | ০৫.০৯.২০২০







মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চোদ্দ ভূতের আসরে

পার্টিশনের জীবনভাষ্য: প্রজন্মান্তরের খোঁজ

বুদ্ধের পুতাস্থি: রাখা রয়েছে কলকাতাতেই