মথ
আবারও
বৃষ্টির জল ঘরে ঢুকবে মনে হচ্ছে। প্রতি বর্ষাতেই সুব্রতর বাড়ির এই অবস্থা হয়।
পুরসভা থেকে ক’দিন আগেই জানিয়ে গেছে, আগামী চার-পাঁচদিনের আগে
বৃষ্টি কমার বিশেষ সম্ভাবনা নেই। খুব প্রয়োজন না হলে বাড়ির বাইরে বেরোতে নিষেধ
করেছে মাইকে। তবে এই রাজনীতি সুব্রতর পরিচিত। চিড়িয়ামোড়ে যখন ভাড়া থাকত,
তখনও এই একই ছবি দেখেছে সে। দল পাল্টায়, রং
বদলায়, সময় একই থাকে। কেউ বদলার বদলে বদল চেয়েছিল,
আর এখন বদলকেই বদলি করে দিয়েছে ভিন রাজ্যে। মাইকের কথায় বিশেষ কান
দেয়নি সুব্রত। সব শালা ভোটের আগে একই কায়দা। অথচ জল যাতে না জমে, তার কোনো ব্যবস্থা করবে না পুরসভা।
—ছোটকা, বাইরে বেরোস না বাবা। নোংরা জল ঘাঁটলে গায়ে চুলকানি হবে। বাবার কথা শোনে
না মেয়ে। বাড়ির সামনে জমা জল ঘাঁটে আর সুর করে বলে, “আয়
বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দেবো মেপে”।
ধান মানেই
তো চাল, সুব্রতর মাথায় চেপে বসে একরাশ দুশ্চিন্তা। জল যে হারে বাড়ছে তাতে সকালেই
ঘর ভেসে যাবে। চাল তো বাড়ন্ত! পরিবার নিয়ে ছাদে উঠলেও তো পেটের জ্বালা মেটাতে
হবে! নিজের উপার্জন আর বৌয়ের কিছু টুকটাক কাজে সংসার চলে যায় কিন্তু প্রকৃতির
মার বড়ো ভয়ানক। সুব্রত হঠাৎ ভাবতে বসে। প্রকৃতি তো মা, মা
কি মারে তার সন্তানদের? সেই যে ছোটোবেলায় ক্লাসে বলেছিলেন
মাস্টারমশাই, “কু-পুত্র যদি বা হয়, কু-মাতা
কদাপি নয়”।
—বলি হাঁ করে বসে
থাকলে হবে? ঘর যে ভেসে যাবে এবার!
বৌয়ের
ঝাঁঝানিতে ঘোর কেটে যায় সুব্রতর। বিরক্ত লাগে। তার ভিতরের কল্পনাগুলোকে বাড়ির
লোক বুঝতেই চায় না! ঘর তো প্রতি বর্ষাতেই ভাসে, এত চিন্তার কী কারণই বা থাকতে পারে?
—শিগগির যাও,
যা যা লাগবে আগামী দিন পাঁচেকের জন্য নিয়ে এসো। কপাল আমার এমন,
বাড়ি থেকেও নেই! সেই আবার সব নিয়ে ছাদে সংসার পাতো!
—সংসার বুঝি তুমি
একাই পেতেছো? আমার কোনো ভাবনা নাই? কত
কষ্টে এই বাড়ি, এই সংসার, মেয়ে,
মা-কে নিয়ে একটু একটু করে সব গড়ে তুলেছি, তোমার
থেকে ভালো তো কেউ জানে না! খামখা অশান্তি করো কেন বুঝি না।
গজগজ করতে
করতে সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে যায় সুব্রত। জল ঠেঙিয়ে কী পাওয়া যাবে জানা নেই, তবু ব্যবস্থা করতে হবে কিছু একটা। সংসার
বড়ো বিষম দায়, চাইলেও এর থেকে বেরোনোর উপায় থাকে না।
বৃষ্টিটা
সামান্য ধরেছে। বিকেলের পর থেকে আকাশের ব্যাজার মুখে যেন নতুন প্রেমের হাসি। এইসব
ছাইপাঁশা নানা ভাবনা কাজ করে সুব্রতর মাথায়, মনে। চুপটি করে নিজের বিছানা থেকে বাইরের দিকে তাকায় আর ভাবে
কত কথা!
—খোকা, আয়। রান্না হই গ্যাসে। তুই খাইয়া নিবি আয়।
এমনভাবে
কতদিন ডাকে না মা! ঘরের এক কোনে বুড়ি মা নিজের মতন থাকে। একটু আচার, আমসত্ত্ব এইসব বানায় আর সুব্রতকে বলে
পাড়ার লোককে বিলি করতে। চিড়িয়ামোড়ের ছোট্ট ভাড়ার ঘরে গাদাগাদি করে সে,
তার ভাই আর মা থাকতো। গরম ভাতে কখনো কখনো হত কুচো চিংড়ি ভাপা। তাতে
কাঁচা সর্ষে বেটে সবটা ভাত হাপুসে শেষ করে দিত তারা। মায়ের জন্য সামান্য কিছুটা
ফ্যান মেশানো ভাত পড়ে থাকতো। মা বলতো,
—আমি যতদিন পারুম,
রান্না করুম। তোগো লগে আর তো কিসুই করবার পারি নে। খাইয়া নিবি বাপ
আমার।
তারপর একদিন
ভাই হারিয়ে গেল। কোথায় যে গেল, কোনো হদিস পাওয়া গেল না। এর অনেক পরে সুব্রতর নিজের সংসার, বাড়ি, মা-কে নিয়ে আসা…
ভাবনা আসে
আবার উধাও হয়ে যায়। বাইরে বোধহয় বৃষ্টি শুরু হল। ফোনের দিকে তাকায় সে। রাত
বাড়ছে। এবার আলো নিভিয়ে ঘুমানোর মিথ্যে চেষ্টায় ঢুকে না পড়তে পারলে আবার
অশান্তি হবে। ভোরে ছোটকাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তার। নিয়ে যেতে না পারলে সেইদিন আর বাড়িতে ভাত জুটবে না।
অগত্যা, ঘুমের অভিনয়টুকুকেই আপাতত সঙ্গী করে নেওয়া যাক।
আলোটা
নেভাতে গিয়ে দেখে একটা মথ ঘুরছে চারপাশে। বর্ষায় ঘরে ভরে যায় বিভিন্ন পোকা। মথ
তো অতি সাধারণ, আকছার ঢুকছে। জল লেগে বোধহয় ডানা ভিজে গেছে, এখন
আলোর তাপে নিজেকে একটু সেঁকে নেওয়া, সুব্রত ভাবে। আলো নিভে
গেলে বাইরে অন্য কোনো আলোর খোঁজে নিজের রাস্তা ঠিক খুঁজে নেবে। আলোটা নেভাতে গিয়ে
ভালো করে মথটাকে দেখে সুব্রত। এমন রং চট করে চোখে পড়ে না! অদ্ভুত সাদার সঙ্গে
হালকা বাদামি ছিট। মথ এত সুন্দর হয়?
—মনে পড়ে একদিন
তুই মশারির নেটে করে অনেকগুলো প্রজাপতি ধরেছিলিস?
—ধুর পাগল,
ওগুলো প্রজাপতি না, মথ ছিল।
—সে যাই হোক,
কেন ধরেছিলিস বল তো?
—ওই যে বিয়ের
কার্ডে দেখেছিলাম কত রঙিন প্রজাপতি। প্রজাপতি তো বড়লোকদের বাড়িতে থাকে, আমার জন্য তাই ওই মথই প্রজাপতি!
—তুই জানিস না,
প্রজাপতি ধরতে নেই?
—যা ধরতে নেই,
তাকেই তো ধরে রাখার সখ হয়। বেঁধে আর রাখতে পারি কই?
—তুই আমাকে ভুলতে
পারিস না এখনও?
—মন দিয়েছি যাকে,
তাকে যে ভোলা যায় না প্রিয়।
—যদি কোনোদিন তোর
বাড়িতে জেনে যায়?
—আমার বৌ আমাকে
ছেড়ে চলে যাবে না, কিন্তু তোর বাড়িতে জানতে পারলে তো গায়ে
আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারবে তোকে!
—আমি মরে গেলে
আমার ছেলেটাকে একটু দেখিস, বন্ধু হিসেবে এটুকুই চাইব তোর
থেকে।
—ফের তোর যত
আজেবাজে কথা শুরু হল। যা ঘুমিয়ে পড়, আবার সময় হলে কথা হবে
ঠিক।
খাপছাড়া
এমন কিছু কথা চলে আসে সুব্রতর মনে। সমস্ত মন অধিকার করে নেয় মাথা, মাথা অর্থাৎ মস্তিষ্ক। মাথার ভিতর কেবল
ঘুরে চলে একটা মথ, তার সোনালি ডানা, ডানার
উপর নীল ছাপ। মোবাইলের দিকে একবার তাকায় সুব্রত, কোনো মেসেজ
আসেনি। মেসেজ আসে না বহুদিন। বৃষ্টি বাড়ছে আবার। বাইরে জলের উপর কীসের যেন শব্দ
হল! সকালে মেয়ের স্কুল, বাড়িতে আগুন জ্বলার তাপ, মায়ের ভাত রাঁধার গন্ধ মিলেমিশে গেল হঠাৎ। সবকিছুর ভিতর উড়ে বেড়াচ্ছে
একটা সাদা রঙের মথ, বাদামি তার ডানা। অদ্ভুত সুন্দর রং
কিন্তু … ভাবনাটা আর শেষ হয় না সুব্রতর। কল্পনাপ্রবণ সে বরাবর কিন্তু বাস্তব
সহজেই কল্পনাকে গলা টিপে মারে। ঘরে জল ঢুকবেই, সংসার নিয়ে
যেতে হবে ছাদে। আর এসব ভাবতে ভাবতেই দেয়ালের কালো টিকটিকিটা গপ করে গিলে ফেলে
মথটাকে। বৃষ্টিতে খাবারের বড়ো অভাব। এমন লোভনীয় খাবারের সন্ধান পেলে সেই সুযোগ
কেউ ছাড়ে?
বিতান দে
০৯.০৭.২০২৫
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন