বর্ণান্ধ রবীন্দ্রনাথ
শিলাইদহের পদ্মা, চরাচর ছড়ানো আঁচলের মতো পদ্মার পাড়ে বাংলার অন্তরঙ্গ গ্রাম, সুন্দর আর সমস্যার সহাবস্থানে দূর থেকেই তাকে দেখছেন এক কবি। জোড়াসাঁকোর তেতলার রেলিংএর ফাঁক গলে দেখা প্রাচীন বট আর সেকালের কলকাতার জলছবি ছাড়িয়ে সেই প্রথম তাঁর এক অন্য জগতের কাছকাছি আসা। কুঠিবাড়ি তাঁর ভাল লাগে না। পদ্মার বুকে অনন্ত জলের উপর অসীম আকাশের নিচেই কাটান সারাটা দিন। সেই প্রথম, যখন কবি রবীন্দ্রনাথের হাত ধরছেন শিল্পী রবীন্দ্রনাথ… মনের গহনের মানসী তাঁকে নিয়ে যাচ্ছে নিরুদ্দেশের পথে, আর প্রকৃতি তার ডালি উপুর করে ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে পরম নৈবেদ্য… সেরকমই একটি দিন… সূর্য ঢলে পড়ছে পদ্মার দিগন্তে, নদীর বুকে তখন গলানো সোনা, দূরের গাছপালায় অস্তরাগের প্রতিধ্বনি… কবি শুনছেন, দেখছেন দুচোখ ভরে। এই দেখা আর এই শোনাকে মনের ভেতর থেকে এনে ঢেলে দিচ্ছেন ছিন্নপত্রের পাতায়… আঠারোশো চুরানব্বই সালে ভাইজি ইন্দিরাকে লেখা তেমনই একটি চিঠির পাতা ওলটাতে গিয়ে নজরে এলো এক আশ্চর্য কথা। বর্ণময় সেই সূর্যাস্ত দেখে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,
“কত রকমেরই যে রং চতুর্দিকে ফুটে উঠেছিল সে আমার মতো সুবিখ্যাত রঙকানা লোকের পক্ষে বর্ণনা করতে বসা ধৃষ্টতামাত্র। কেবল আকাশে নয়, পদ্মার জলে এবং বালির চরেও কাল হঠাৎ রঙের ইদ্রজাল লেগে গিয়েছিল…’’।
রবীন্দ্রনাথ, বিশ্বকে কবিতার রঙে, মানবতার রঙে রাঙিয়েছেন যিনি, সেই তিনিই যে বাস্তবজীবনে ছিলেন রঙকানা— ছিন্নপত্রের এই চিঠিতে রয়েছে তারই আত্ম-স্বীকারোক্তি।
রবীন্দ্রনাথ যে খানিকটা বর্ণান্ধ ছিলেন তা তাঁর জীবনের আরও নানা ঘটনা থেকেই বোঝা যায়। কবির খুব প্রিয় ফুল ছিল পলাশ। কিন্তু লাল রঙের ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুব কম সংবেদনশীল। তারচেয়ে বরং সবুজ বা নীল রঙ তাকে ঢের বেশি আকৃষ্ট করতো। শুধু তাই না, সুবজের বিভিন্ন ‘শেড’ তিনি সহজেই সনাক্ত করতে পারতেন, এবং এই বিষয়ে তাঁর ক্ষমতা অনেকক্ষেত্রেই ছিল সাধারণের চেয়ে বেশি। তার কাছে সবুজের বৈচিত্র্য এতই বেশি ছিল যে প্রায়শই তাঁর মনে হত এত আলাদা আলাদা সবুজকে কীভাবে লোকে শুধু ‘সবুজ’ নামে ডাকে!
রবীন্দ্রনাথের বর্ণান্ধতার সরাসরি সাক্ষ্য পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের খুব কাছের একজন মানুষের লেখায়। তিনি প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশের স্ত্রী নির্মলকুমারী মহলানবিশ। তাঁর ‘বাইশে শ্রাবণ’ বইয়ের ‘আনন্দমেলায় কবির গল্প’ রচনায় নির্মলকুমারী লিখেছেন,
‘পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল যে উনি রঙকানা ছিলেন। লাল রঙটা চোখে পড়তো না, মানে লাল আর সবুজের বেশী পার্থক্য বুঝতে পারতেন না। কিন্তু কোন জায়গায় নীলের একটু আভাসমাত্র থাকলেও সেটি তার দৃষ্টি এড়াতো না। বাগানে ঘাসের মধ্যেও খুব ছোট নীল রঙের একতা জংলী ফুল ফুটে থাকলেও ঠিক ওর চোখে পড়তো। বলতেন, ‘দ্যাখো দ্যাখো, কী চমৎকার ফুলটা’। অথচ আমরা হয়তো লক্ষ করেও ফুলটি খুঁজে বের করতে মুশকিলে পড়তাম। হাসতেন আর বলতেন, ‘কী আশ্চর্য, এত স্পষ্ট জিনিসটা দেখতে পাচ্ছো না? অথচ আমি তোমার লাল ফুল ভাল দেখতে পাইনে বলে আমাকে ঠাট্টা করো। নীল রঙটা যে পৃথিবীর রঙ, আকাশের শান্তির রঙ, তাই ওটার মধ্যে আমার চোখ ডুবে যায়; আর লাল রঙটা হল রক্তের রঙ, আগুনে রঙ অতএব প্রলয়ের রঙ, মৃত্যুর রঙ – কাজেই বেশী না দেখতে পেলে দোষ কি?’
নির্মলকুমারী আরও লিখেছেন,
‘আমার লাল রঙ পছন্দ বলে আমাকে কত সময় নীলমণিলতার ফুলের গুচ্ছের দিকে দেখিয়ে ঠাট্টা করে বলেছেন, কি এখনও তুমি লাল রঙ ভাল বলবে?’ আমিও…উত্তর দিয়েছি… তাহলে আপনি পলাশ এত ভালবাসেন কেন?’ উত্তরে তিনি বলে উঠতেন, ‘পলাশটা কি শুধুই লাল? ওতে কতখানি হলদে মেশানো রয়েছে, তাছাড়া ঘোর সবুজ – প্রায় কালো আর একটা রঙ আছে, এই দুই মিলিয়ে তবে তো পলাশের বাহার? তাছাড়া পলাশের গড়নটার কথাও তো ভুললে চলবে না’।
কেবল নির্মলকুমারীই নয়, বিচ্ছিন্নভাবে রোমা রঁল্যা, স্টেলা ক্রামরিশ, জগদীশচন্দ্র, রাণী চন্দ সহ অনেকের কাছেই রবীন্দ্রনাথের এই বর্ণান্ধতার ব্যাপারটা ধরা পড়েছিল। যেমন রাণী চন্দ তার ‘আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ’-এর ভূমিকায় লিখেছেন,
‘গুরুদেব প্রায়ই বলতেন তিনি রঙকানা, বিশেষ করে লাল রঙটা নাকি তার চোখেই পড়ে না। অথচ দেখেছি অতি হাল্কা নীল রঙও তার চোখ এড়ায় না। একবার বিদেশে কোথায় যেন ট্রেনে যেতে যেতে তিনি দেখছেন অজস্র ছোট ছোট নীল ফুলে রেললাইনের দুদিক ছেয়ে আছে। তিনি বলতেন, ‘আমি যত বউমাদের ডেকে ডেকে সে ফুল দেখাচ্ছি- তাঁরা যেন দেখতেই পাচ্ছিলেন না। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছিলুম, এমন রঙও লোকের দৃষ্টি এড়ায়’।
কেবল তৃতীয়পক্ষের জবানবন্দিতে নয়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও যে এই বিষয়টি জানতেন তার নজির আমরা প্রথমেই দিয়েছি ভাইজি ইন্দিরাকে লেখা চিঠির উল্লেখ করে। এরকমই আরেকটি চিঠি রয়েছে। এই চিঠিটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ১৯৩১ সালে। ড. সরসীলাল সরকারকে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
‘চৈতন্যের নানা দিক আছে, এক আলো থেকেই নানা রঙের বোধ, এও তেমনি। কেউ লাল রঙ দেখতে পায় না, কেউ নীল, কেউ বা এটা বেশী দেখে, কেউবা ওটা। আমি আজকাল ছবি আঁকি, সেই ছবিতে বর্ণসংযোজনের বিশেষত্ব আছে। এই বিশেষত্বের কারণ আমার চৈতন্যে রঙের বিশেষ ধারণার মধ্যে। আমি সব রঙকে সমান দেখিনে, পক্ষপাত আছে, কেন আছে কে বলবে?’
কেবল চিঠিপত্রে নয়, রবীন্দ্র সাহিত্যে চোখ রাখলেও দেখা যাবে, রবীন্দ্রনাথ লালের বদলে বেশির ভাগ সময় ‘রাঙা’ আর সবুজের বদলে ‘শ্যামল’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। লাল যেন তাঁর কাছে ছিল ধূসর যন্ত্রণার মতন- ‘মোর বিরহ বেদনা রাঙালো কিংশুক রক্তিমরাগে’। আর নিজের এই ‘রঙকানা’ দুর্বলতা বিষয়ে সচেতন ছিলেন বলেই হয়তো ছবি আঁকার ব্যাপারে ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ এবং গগনেন্দ্রনাথকে সারাজীবন ধরে উৎসাহ দিয়ে গেলেও নিজে প্রথাগত অঙ্কন শিক্ষা নেননি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের এই বর্ণান্ধতার ব্যাপারটা হঠাৎ করেই ধরা পড়ে গিয়েছিল কবির অন্তরঙ্গ বন্ধু বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর একটি ছোট্ট পরীক্ষায়।
একবার জগদীশচন্দ্র বসু সিসার স্ফটিক বা গ্যালিনা দিয়ে তৈরি একটি ‘গ্রাহকযন্ত্র’ বানিয়েছিলেন, যাকে তিনি ডাকতেন ‘কৃত্রিম চক্ষু’ বলে। এটাকে কৃত্রিম চক্ষু ডাকার কারণ হল, যন্ত্রটি সাধারণ আলো তো বটেই এর বাইরে বিদ্যুৎ রশ্মি, অতিবেগুনি রশ্মি, অবলোহিত রশ্মি ইত্যাদি ধরতে পারত। বিজ্ঞানের ভাষায় বললে, আমাদের চোখ যে সকল আলোতে সংবেদনশীল, জগদীশচন্দ্রের যন্ত্রটি এর চেয়ে আরো অনেক বেশি তরঙ্গের আলো সনাক্ত করতে পারতো। জগদীশ বসু যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত তারগুলোকে অপটিক নার্ভের সাথে তুলনা করেছিলেন। অপটিক নার্ভ আলোর উদ্দীপনা বহন করে আমাদের মস্তিষ্কে নিয়ে যায়। জগদীশের যন্ত্রের ক্ষেত্রে এই ‘মস্তিষ্ক’ ছিল একটি ব্যাটারি বা পাওয়ার সেল, যা ক্রমাগত শক্তির যোগান দিচ্ছিল। একদিন রবীন্দ্রনাথ যন্ত্রটি দেখতে আসলেন, এসে যন্ত্রটি যে আংশিক ‘সবুজ কানা’ সেটা সনাক্ত করে ফেললেন। এটা দেখে জগদীশচন্দ্র বিস্ময়প্রকাশ করে পরে একটি চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। পড়ে নেওয়া যাক সেই চিঠির কিছু অংশ…
আমি সম্প্রতি একটি অত্যাশ্চর্য কৃত্রিম চক্ষু প্রস্তুত করিতে সমর্থ হইয়াছি। এই চক্ষে অনেক আলো দৃষ্ট হয়, যাহা আমরা দেখিতে পাই না। তা ছাড়া ইহা রক্তিম বা নীল আলো অতি পরিষ্কার রূপে দেখিতে পায়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ইহা slightly green-blind। আপনার চক্ষু ইহা কি করিয়া অনুকরণ করিল বুঝিতে পারি না”।
জগদীশচন্দ্রের বিস্ময়ের কারণকে ব্যাখ্যা করে অনেকেই আজ বলেন যে, জগদীশ্চন্দ্রের কৃত্রিম চক্ষু যে আংশিক সবুজকানা ছিল, অর্থাৎ সবুজ আলো দেখার ত্রুটি ছিল, তা ধরা সম্ভব ছিল একজন লালকানার পক্ষেই। সেজন্যই বোধ হয় রবীন্দ্রনাথ অতি সহজেই সেটা ধরতে পেরেছিলেন, আর সেটাই হয়েছিল জগদীশচন্দ্র বসুর বিস্ময়ের কারণ।
কিন্তু কেন রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এই বর্ণান্ধতা সৃষ্টি হয়েছিল? চিকিৎসাবিজ্ঞানের আলোচনায় এই নিয়েও হয়েছে গবেষণা, আর উঠে এসেছে চমকপ্রদ সব তথ্য। আসুন তারই কিছু কিছু শুনে নেওয়া যাক।
রবীন্দ্রনাথ যে ধরনের বর্ণান্ধতায় আক্রান্ত ছিলেন তা হল, আংশিক বর্ণান্ধতা—মূলত লাল ও সবুজরঙের সমস্যা। লাল রঙ দেখার অক্ষমতাকে বলা হয় ‘লোহিতান্ধতা’ বা ‘প্রটোনোপিয়া’ এবং সবুজ রঙের অন্ধতাকে বলা হয় ‘ডিউটার আন্যোপিয়া’। এগুলি মূলত বংশগত কারণে হয়।। গবেষণায় দেখা গেছে গোটা বিশ্বে শতকরা ৮ ভাগ পুরুষ এবং ‘শূন্য দশমিক চার’ (০.৪) ভাগ নারী এই সমস্যায় অল্পবিস্তর আক্রান্ত। কেন পুরুষদের মধ্যে বর্ণান্ধতা বেশি আর নারীদের মধ্যে কম, সেটি অবশ্য রহস্য। তবে বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন এর কারণ লুকিয়ে আছে আমাদের বিবর্তনের যাত্রা পথে। বিবর্তনের যাত্রাপথের একটা বড় অংশে পুরুষেরা শিকারী হিসেবে আর নারীরা সংগ্রাহক হিসেবে জীবন কাটিয়েছিল। সে সময় থেকেই প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় নারীদের ক্ষেত্রে গন্ধ এবং বর্ণের ব্যাপারটা পুরুষদের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কোন্ ফল বিষাক্ত, কোন্ ফল শরীরের জন্য উপকারী হতে পারে, কোনটা খেলে পুষ্টি দেবে ইত্যাদি ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হত নারীদেরকেই। রান্নার স্বাদ গন্ধও দেখতে হত তাদেরকেই। একারণেই নারীদের বর্ণ এবং গন্ধ সচেতনতা পুরুষদের চেয়ে উন্নত।
অন্যদিকে জেনেটিক্সের গবেষকেরা এই বংশগত রোগের ব্যাপারটিকে দেখেন জিনের কারসাজি হিসেবে। বৈজ্ঞানিকভাবে তারা এ রোগটির নাম দিয়েছেন ‘এক্সলিঙ্কড রিসেসিভ ডিসঅর্ডার’। অর্থাৎ X- ক্রমোজমের গোলমালেই ঘটে রঙের এই বিপত্তি। আমরা জানি মেয়েদের দেহকোশ গঠিত হয় দুটি এক্স ক্রোমোজোম (XX) দিয়ে, আর পুরুষদের থাকে একটি এক্স এবং আরেকটি ওয়াই, অর্থাৎ XY ক্রোমোজোম। মেয়েদের দুটি এক্স ক্রোমোজোম থাকায় বংশে প্রটোনোপিয়া থাকলেও অস্বাভাবিক রিসেসিভ জিনটি মেয়েদের শরীরে প্রটানোপিয়ার প্রকট প্রকাশ ঘটায় না। কিন্তু হেটারোজাইগাস মায়ের পুত্রদের ক্ষেত্রে প্রটানোপিয়াতে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত এই জন্মগত রোগটি পেয়েছিলেন মায়ের দিক থেকে। ধারণা করা হয় তাঁর মাতামহ প্রোটানোপ ছিলেন।
এখন রবীন্দ্রনাথের এই বর্ণান্ধতা কীভাবে প্রভাবিত করেছে তাঁর বিপুল সৃষ্টির জগতকে— এই গবেষণা নিছক সাহিত্যের গবেষণা নয়, আবার কেবল বিজ্ঞানের আতস কাঁচেও বিচার করা যাবে না এই আলো-আঁধারির খেলাকে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় গানে ‘রাঙা’ আর ‘শ্যামল’-শব্দের রহস্যময় উল্লেখের প্রসঙ্গ তুলে ধরে আমাদের চমকে দিয়েছিলেন কেতকি কুশারি ডাইশন তাঁর ‘রঙের রবীন্দ্রনাথ’ বইতে। কিন্তু এরই সঙ্গে আশ্চর্য হতে হয়, যখন দেখি, নিজের ‘রঙের দুর্বলতা’ জানা রবীন্দ্রনাথ, যিনি শৈশব আর কৈশরে সুযোগ থাকলেও এড়িয়ে গেলেন ছবি-আঁকার চর্চা, সেই তিনিই ‘শেষ বয়স’-এর ‘প্রিয়া’ করলেন চিত্রকলাকেই। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সৌজন্যে পশ্চিম দুনিয়া চিনল কবির এক নতুন সত্তাকে। ভাবুন একবার, যিনি লাল আর সবুজ রঙের অসুবিধায় আক্রান্ত, চিত্রকর হয়ে তিনিই রঙের রেখায় ভরিয়ে তুলছেন ক্যানভাস। নিঃসন্দেহে যা ‘আপাত সাধারণ’-এর থেকে হয়ে যাবে পৃথক, যারা রবীন্দ্রনাথের ছবির সাথে পরিচিত তারা অনেকেই জানেন তার ছবিতে গাঢ় রঙের আধিক্য। বিশেষ করে খয়েরি এবং কালো রঙের উগ্র ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। লালচে খয়েরি, কালচে খয়েরি, নীলচে খয়েরি, বেগুনি-খয়েরি প্রভৃতির অনেক শেড রবীন্দ্রচিত্রকলাকে আচ্ছন্ন করে আছে, এবং এর প্রধান কারণ রবীন্দ্রনাথের বর্ণান্ধতা।
তবে একথা না বললেও হয়তো চলে যে, বর্ণান্ধতার ব্যাপারটি রবীন্দ্র চিত্রকলাকে বা তাঁর সৃষ্টির অন্য জগতকে একটি ভিন্নমাত্রা দিলেও তাঁর প্রতিভার স্ফুরণে এটি কোন সীমাবদ্ধতা তৈরি করেনি। ঠিক যেমন বিথোফেনের বধিরতা তার সুরের মূর্ছনা তৈরিতে কোন প্রতিবন্ধকতা আনতে পারেনি।
তবে রবীন্দ্রনাথের বর্ণান্ধতা নিঃসন্দেহে তার কাজকে দিয়েছে খানিকটা ভিন্নতা এবং স্বাতন্ত্র্য। ছবি আঁকায় যেভাবে তিনি রঙের ব্যবহার করেছেন, দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক থাকলে হয়তো সেভাবে ব্যবহার করতেন না। চিত্রশিল্পী দেবরাজ গোস্বামী তাঁর একটি প্রবন্ধে লিখেছেন–
‘রঙের রবীন্দ্রনাথ পড়বার পর আবার যখন রবীন্দ্রনাথের ছবিগুলো দেখি সেখানে লক্ষ করি লাল রঙের পাশে সরাসরি কালো বা কোন গাঢ় অন্ধকার রঙ ব্যবহার করতে তিনি মানসিক দোলাচলের মধ্যে পড়েছেন। যেখানে এই দুটি রঙ পাশাপাশি প্রয়োগ করলেই একটা জোরালো বৈপিরত্য তৈরি হয় এবং ড্রইংটি বেরিয়ে আসে। সেখানে তিনি এই দু’রঙের মধ্যবর্তী স্থানকে সারফেসের সাদা কিংবা কোন হাল্কা রঙের একটি রেখা দিয়ে বিভাজন করেছেন। সম্ভবত হয় লাল ও কালো রঙের বৈপরীত্য সম্পর্কে কবি নিশ্চিত হতে পারতেন না অথবা তাঁর নিজস্ব বর্ণান্ধতার কারণে পাছে মূল ড্রইংটি হারিয়ে ফেলেন, এই আশঙ্কা থেকে ব্যাপারটি করতেন। কিন্তু এই কাজ করার ফলে আপনা থেকেই রবীন্দ্রনাথের ছবিতে একটা নিজস্ব চরিত্র তৈরি হয়েছে যা নান্দনিক বিচারে সদর্থক’।
আসলে কবির দৃষ্টির পথে কোনো বাধাই বাধা হয়ে উঠতে পাড়ে না। চোখের দেখার চাইতেও মনের দেখার শক্তি আছে বলেই তো কবির চেতনায় ফুটে ওঠে রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ আর রঙের সেই আশ্চর্য খেলা। আসলে তো রঙ বলে কিছু নেই পৃথিবীতে, পদার্থবিজ্ঞান যাকে চেনায় ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্য হিসেবে, চোখের অভ্যন্তরে থাকা আলোকসুবেদি রঞ্জক তাকেই গ্রহণ কোরে নির্মাণ করে ভিন্ন ভিন্ন বৈদ্যুতিক বিভব। স্নায়ুর পথ ধরে এগিয়ে চলে সেইসব বিভব পৌঁছয় আমাদের মস্তিষ্কে। আর মস্তিষ্ক আমাদের চেনায় রঙ, বলে দেয় এটা সবুজ, এটা লাল, আর ওইটা নীল। হয়তো একথা জানতেন আমাদের ‘রঙকানা’ কবিও। তাই তো ‘আমি’ কবিতায় তিনি লিখেছিলেন,
“আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,/চুনি উঠল রাঙা হয়ে।/আমি চোখ মেললুম আকাশে/ জ্বলে উঠল আলো/ পুবে পশ্চিমে/ গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর’/ সুন্দর হল সে।”...।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন