জালিয়ানওয়ালাবাগ শতবর্ষ পেরিয়ে
ঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে চারটে-পাঁচটা! দিনটা ছিল ১৩ এপ্রিল ১৯১৯, রবিবার। দুদিন আগে হাওড়া স্টেশন থেকে পঞ্জাব মেল-এ উঠেছিলেন ‘দ্য ট্রিবিউন’ কাগজের সহকারী সম্পাদক অমল হোম। ট্রেনটির সেদিনই দুপুরে লাহৌর পৌঁছোনোর কথা। কিন্তু পাঁচ ঘণ্টা লেট করে সেই ট্রেন যখন অমৃতসর স্টেশনে ঢুকল, তখন প্ল্যাটফর্ম ছেয়ে ফেলেছে ইংরেজ সৈন্য। গাড়িতে চলছে খানাতল্লাশি। ঠিক তখনই সেই বাঙালি সাংবাদিকের কানে এল বিকট কড়কড়কড় শব্দ! খুব কাছ থেকেই যেন আসছে! কিন্তু কীসের শব্দ? কী হচ্ছে সেখানে? অমল হোম লিখছেন, ‘একটা গোরাকে জিজ্ঞাসা করলাম— ব্যাপারখানা কী? উত্তরে সে স্টেশনের বাইরে, শহরের দিকে তার বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা বাড়িয়ে দিয়ে জানালে—লটস অব ফান গোয়িং অন দেয়ার— ওখানে দেদার মজা চলছে!’
মজা! সত্যিই তো মজা ছিল সেটা! কয়েক হাজার নিরস্ত্র ভারতীয়কে ঘিরে ধরে গুলির নির্মম নির্লজ্জ বর্ষণ। পৃথিবীর ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা। জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যা— ১৯১৯-এর ১৩ এপ্রিল, সেদিন বিকেলেই কিছুক্ষণ আগে অমৃতসরের আকাশে দেখা গিয়েছিল যুদ্ধবিমান। জালিয়ানওয়ালাবাগের মাথার ওপর চক্কর দিয়ে সে দেখে নিয়েছে, ভিড় কতটা জমল!
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জয়ের উল্লাসে ইংরেজদের তখন পৌষমাস। সাম্রাজ্যবাদের মুঠি এবার আরও শক্ত হবে। লাহৌরের কমিশনার কিচিন খোলাখুলি বলেই দিয়েছিলেন, ‘সরকার জার্মানি জয় করেছে, সে এখন যে-কোনও কিছু করতে সক্ষম। সবাইকে তাই সরকারের আদেশ পালন করতেই হবে।’ জার্মানিকে যখন শায়েস্তা করা গেছে, তখন জার্মান মদতপুষ্ট গদরপন্থী বিপ্লবীদের মুল্লুকে এ বার হিসেব বুঝে নেওয়া হবে। বাংলার বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগসাজশ আর ইংরেজ-বিরোধিতা ঘুচে যাবে জন্মের মতো। আর এই ‘রাওলাট সত্যাগ্রহ’ নামের নতুন যে ব্যারামটা দেখা দিয়েছে তার দাওয়াইও তৈরি হচ্ছে।
সেই দাওইয়াই দেওয়া শুরু হয়েছিল দু’দিন আগে থেকেই। ১১ই এপ্রিল সন্ধেয় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ার অমৃতসরে পৌঁছে দায়িত্ব নেওয়ার পরই সে দিন গভীর রাতে বিদ্যুৎহীন করে দিলেন গোটা শহরটাকে। পর দিন সকাল থেকেই শহরবাসীর মাথার ওপর চক্কর দিতে লাগল রয়্যাল এয়ারফোর্সের যুদ্ধবিমান। ১২ তারিখ থেকে শহরের দখল নিল জেনারেল ডায়ার-এর সেনা। নিজে তিনি বেরোলেন দুটো সাঁজোয়া গাড়ি সঙ্গে নিয়ে। গোটা অমৃতসর শহরে তখন বিদ্যুৎ নেই, জল নেই। বিশেষ ছাড়পত্র ছাড়া কারও পক্ষে শহরে ঢোকা বা শহরের বাইরে বেরোনো কার্যত অসম্ভব। বোঝা যাচ্ছিল কোনো একটা ভয়ংকর ষড়যন্ত্রে ক্রমশ মুড়ে ফেলা হচ্ছে পঞ্চনদের পারের এই শহরকে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন সবেমাত্র শেষ হয়েছে। যুদ্ধের শেষে ভারতীয়দের স্বায়ত্বশাসন দেওয়ার টোপ তখন গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে সাহেবদের। কয়েক লক্ষ ভারতীয় সৈন্য তাঁদের হয়ে যুদ্ধের খিদমৎ খাটলো, বিশেষ করে পঞ্জাব প্রদেশের তো প্রায় প্রতিটি ঘর থেকে একজন দুজন করে সেনাদলে নাম লিখিয়েছিল, কিন্তু যুদ্ধ শেষে জাত চেনাতে লাগল ব্রিটিশরা, কীসের স্বায়ত্বশাসন? কীসের স্বরাজ? সাম্রাজ্যবাদের থাবা আরও হিংস্র হয়ে নেমে এলো এক আজব আইনের চেহারায়! সে আইনের নাম ‘রাওলাট অ্যাক্ট’, ১৯১৯-এর ১০ মার্চ যা বলবৎ করা হয়। কুখ্যাত এই ‘রাওলাট অ্যাক্ট’ ছিল নেটিভ’ জনসাধারণকে শায়েস্তা করার এক চূড়ান্ত স্বৈরাচারী কৌশল। এই আইন অনুসারে, যেখানে সেখানে যে কাউকে ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তার করা যেতে পারে, বিনা বিচারে আটকেও রাখা যেতে পারে, যত দিন খুশি! কোনও প্রমাণও লাগবে না! যদি কোনও ব্রিটিশ-বিরোধী নথি বা বই পাওয়া যায় কোনও ‘সন্দেহভাজন’ ব্যক্তির কাছে, তাহলেও তাঁকে আটক করা যাবে। কোনও অ্যাপিল চলবে না, কোনও জুরি থাকবে না। মোট কথা আইনের নামে এ ছিল এক নিদারুণ প্রহসন!
কিন্তু দেশ জুড়ে শুরু হল এর তীব্র প্রতিবাদ। গোটা পঞ্জাব জুড়েও যা ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মতো। অমৃতসরের জায়গায় জায়গায় হতে লাগল মিটিং, মিছিল আর সংঘর্ষ।
শহরের ইংরেজ প্রশাসকদের খুবই চিন্তা ও অস্বস্তিতে ফেলেছিল স্থানীয় দুই কংগ্রেস নেতা সইফুদ্দিন কিচলু ও সত্যপাল। এঁদের নেতৃত্বে মার্চ মাস থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল শান্তিপূর্ণ রাওলাট আইন প্রতিরোধ কর্মসূচি। যাতে মুসলমান-হিন্দু-শিখ সকলেই মিলিতভাবে যোগদান করেছিল। অতঃপর ওই দুই নেতার বিরুদ্ধে তড়িঘড়ি ফতোয়া জারি করা হল, বলা হল, তারা কোনও জনসভায় ভাষণ দিতে পারবে না। তা সত্ত্বেও ৬ এপ্রিল এক বিরাট জমায়েত হল। সেখান থেকে দাবি উঠল, কিচলু ও সত্যপাল-এর উপর থেকে ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে। সেদিনই পুরো শহর স্তব্ধ করে হরতাল হল। মানুষ যে ক্রমশ জোট বাঁধছে তা বুঝতে পেরেছিলেন পঞ্জাব প্রদেশের সাহেব কর্তারা।
কিন্তু তখনও পর্যন্ত পঞ্জাবে রাওলাট সত্যাগ্রহকে ঘিরে তেমন কোনও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেনি। ৯ তারিখ গান্ধীজীর পঞ্জাব প্রবেশ আটকে দেওয়া হল। তার পরদিনই সইফুদ্দিন কিচলু আর সত্যপালকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হল কোনও ‘অজানা’ গন্তব্যে। নেতাদের গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষুব্ধ অমৃতসরবাসী ১০ এপ্রিল পথে নামলেন। আগুন জ্বলল কিছুক্ষণের মধ্যেই। নেতাদের মুক্তির দাবিতে প্রচুর মানুষ হাঁটছিলেন শহরের ডেপুটি কমিশনারের বাড়ির অভিমুখে। মিলিটারি পিকেট তাঁদের পথ আটকানোর পর ব্যারিকেড ভেঙে কিছু মানুষ এগোনোর চেষ্টা করলে শুরু হয়ে যায় গণ্ডগোল। অচিরেই ভিড় লক্ষ্য করে গুলি চালায় সেনা, কুড়ি-পঁচিশ জনের মৃত্যু ঘটে! এরপর জনতার একাংশও হয়ে ওঠে উন্মত্ত। তারা আক্রমণ করে টাউন হল, দুটো বিদেশি ব্যাঙ্ক, টেলিগ্রাফ আর টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অফিস। মারমুখী জনতার হাতে পাঁচ জন সাহেবের প্রাণ যায়। দু’জন মেমসাহেব আক্রান্ত হয়ে কোনও রকমে পালিয়ে বাঁচেন। সঙ্গে সঙ্গে গোটা শহরে জারি হয়ে গেল মিলিটারি শাসন। অমৃতসরে ১৩০ জন ইংরেজ নরনারীকে সুরক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি নেটিভদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার বন্দোবস্ত শুরু হতে বেশি দেরি হল না।
পরদিন অর্থাৎ ১১ এপ্রিল, সকাল থেকে আকাশে বোমারু বিমান, রাস্তায় কারফিউ আর সেনা টহল। রাতেই শহরে পা রাখলেন জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার খলনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ার। ১২ তারিখে শহরের কিছু জায়গায় তিনি নোটিস ঝুলিয়ে মিটিং-জমায়েত নিষিদ্ধ করে দিলেন। কিন্তু শহরের কিছু মান্যগণ্য মানুষ ঠিক করলেন, পর দিন, ১৩ তারিখ বিকেলে একটা শান্তিপূর্ণ মিটিং করে কিচলু ও সত্যপাল-এর মুক্তির দাবি তোলা হবে, সেই সঙ্গে ১০ তারিখের অনভিপ্রেত ঘটনার পর সাধারণ মানুষের চরম হয়রানি ও যথেচ্ছ গ্রেফতারের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানানো হবে। সেইমতোই বিকেল চারটে থেকেই জমায়েত শুরু হয় স্বর্ণমন্দিরের কাছাকাছি বাগান-চত্বরে। ওখানে নিয়মিত মিটিং হত। সে দিন কিন্তু কোনও নোটিস ঝোলানো ছিল না ওই চত্বরে, ঢোকার মুখে ভিড় আটকানোর চেষ্টাও হয়নি, যদিও চারদিকে ছিল প্রখর নজরদারি।
মিটিং শুরু হওয়ার পর ডায়ার তাঁর প্ল্যানমাফিক ওই চত্বরের একমাত্র সরু প্রবেশ-প্রস্থান পথের মুখে দুটো সাঁজোয়া গাড়ি লাগালেন। বেয়াদব লোকগুলো যাতে দৌড়ে বেরিয়ে পালাতে না পারে, সে জন্যে রাস্তার দু’ধারে মিলিটারি পিকেট বসানো হল। আকাশপথে পরিদর্শনও সম্পূর্ণ! হাঁটু-গেড়ে বসা বালুচ আর গোর্খা সৈন্যরাও প্রস্তুত, আর তার পরেই এলো পৃথিবীর নৃশংতম গণহত্যার হুঙ্কার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ার হুকুম দিলেন ‘ফা---য়া----র’, শুরু হল তীব্র গুলিবর্ষণ! ভিতরে তখন প্রায় হাজার খানেক লোকের জমায়েত। এর মধ্যে কয়েকশো লোককে খতম না করতে পারলে কীভাবে প্রতিশোধ নেওয়া যাবে, কীভাবে ভেঙে দেওয়া যাবে যত বিদ্রোহ-সত্যাগ্রহ-বিপ্লবী চক্রান্ত! অতঃপর গুলি চলল, রাউন্ডের পর রাউন্ড। জালিয়ানওয়ালার বাগে সেদিন মুহূর্তেই নিভে গেল কয়েক শো মানুষের জীবনদীপ, গুলিতে তো বটেই আরও বহু মানুষের মৃত্যু হল আত্মরক্ষার তাড়নায় কুয়োঁতে ঝাঁপ দেওয়ার ফলে। সেই কুয়োঁর উপরেই এখন নির্মাণ করা হয়েছে শহিদ স্মারক ‘শহিদি কুঁয়া’, যার অতলে এখনও মিশে আছে বহু বহু মানুষের আর্তনাদ, মিশে আছে সেদিনের ভয়ানক, ভয়ানক বীভৎসতার বিরুদ্ধে সন্ত্রস্ত চিৎকার।
১৫ এপ্রিল থেকে গোটা পঞ্জাবে জারি হয়ে গেল সামরিক শাসন। প্রায় দু’মাসের ওই দুঃসহ শাসনকালে পঞ্জাবের মানুষ অসহ্য নির্যাতন ও হেনস্তার শিকার হয়েছেন। কিন্তু তার কোন খবরই ধরা নেই কোনও নথিপত্রে— কারণ চালু হয়েছিল প্রেস সেন্সরশিপ। পঞ্জাব কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল গোটা দেশের থেকে। এতো বড়ো একটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও দেশনেতারা প্রায় কেউই আসতে পারেননি পঞ্জাবে। পোস্ট অফিসগুলোতেও বসেছিল সেন্সর। যাতে পঞ্জাবের কোনও খবর চিঠির মাধ্যমেও না বাইরে পৌঁছোয়। লাহৌর-নিবাসী সরলা দেবী চৌধুরাণীর লেখা থেকে জানা যায়, বিশেষ করে পঞ্জাব-বাংলার মধ্যে যাতে খবর চালাচালি না হয়, সেই কারণে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বহু বাঙালি পোস্টাল ক্লার্ককে, যাঁরা সব বাংলা চিঠি খুলে খুলে পড়তেন।
সুদূর পাঞ্জাব থেকে বহু দূরের বঙ্গদেশে জালিয়ানওয়ালাবাগের খবর আসতে তাই লেগে গেল প্রায় এক মাস। শান্তিনিকেতনের শিক্ষক, রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য সি এফ অ্যান্ডরুজ তখন শান্তিনিকেতন থেকে দিল্লি গিয়েছিলেন। দিল্লি হয়ে সিমলায় এসে তিনি জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা সম্পর্কে কিছু খবর পেয়েছিলেন। ১৯১৯ সালের পয়লা মে লেখা এক চিঠিতে তিনি রবীন্দ্রনাথকে জানান, কীভাবে ইংরেজ সরকার ‘অসহায় … আর কেবল লাঠি হাতে থাকা জনসমাবেশে মেশিনগান গুলি ছোটাচ্ছে।’ চিঠি গোয়েন্দাদের হাতে পড়তে পারে, এমন শঙ্কায় অ্যান্ডরুজ আর বেশি কিছু লিখতে পারেননি। অ্যান্ডরুজ এরপর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য অমৃতসর যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ তাঁকে ট্রেনেই আটক করে দিল্লি পাঠিয়ে দেয়। এ ঘটনা পরে জেনে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত মর্মাহত হন, ওই সময়ের দুশ্চিন্তা ও রাগের প্রকাশ দেখা যায় ২২ মে ১৯১৯ সালে রানু অধিকারীকে লেখা এক চিঠিতে: ‘তোমরা তো পাঞ্জাবে আছ, পাঞ্জাবের দুঃখের খবর বোধ হয় পাও। এই দুঃখের তাপ আমার বুকের পাঁজর পুড়িয়ে দিলে।...’ ২২ মে তারিখেই রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে চলে আসেন কলকাতায়। মনের মধ্যে তাঁর ক্ষোভ তখন আগুনের মতো জ্বলছে, একটা প্রতিবাদ হওয়া দরকার। দরকার একটা প্রচণ্ড প্রত্যাঘাত। কিন্তু কীভাবে? কীভাবে একজন কবি, যিনি সক্রিয় রাজনীতির পরিসর ছেড়ে গিয়েছেন বছর দশেক আগেই, এখন কে তাঁর কথা শুনবে? রবীন্দ্রনাথ তাই শরণাপন্ন হলেন গান্ধীজীর। পাঞ্জাবে তখন অন্য রাজ্যের বাসিন্দাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে ব্রিটিশ সরকার। রবীন্দ্রনাথ তাই গান্ধীজিকে প্রস্তাব পাঠালেন যে, তিনি এবং মহাত্মা মিলে প্রথমে দিল্লি গিয়ে তারপর যদি পাঞ্জাবে প্রবেশের চেষ্টা করেন, তাহলে একটা বড়সড় প্রতিবাদ হয়। এতে যদি ইংরেজ প্রশাসন তাঁদের গ্রেপ্তারও করে, তাতে প্রতিবাদের ও জনমনের প্রতিক্রিয়ার স্ফুলিঙ্গ আরও তীব্র হবে। রবীন্দ্রনাথের এই প্রস্তাবে গান্ধীজি সরাসরি ‘না’ বলে দেন, বলেন, ‘আমি এখনই সরকারকে বিব্রত করতে চাইছি না।’ কবি একথা শুনে স্তব্ধ হয়ে পড়েছিলেন।
তবে হতোদ্যম হননি। গান্ধীকে যখন সঙ্গে পেলেন না, তখন তিনি গেলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ-এর কাছে। কিন্তু গান্ধীর মতো তিনিও কবিকে হতাশ করেন। মনের ভেতর বিপুল বেদনা ও রাগ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ওই দিনই সিদ্ধান্ত নেন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া নাইটহুড উপাধি ত্যাগ করে বড়লাটকে চিঠি লিখবেন। তারপর সারা রাত জেগে সেই ঐতিহাসিক চিঠিটির খসড়া চলল।
তারিখটা ছিল, ৩১ মে, ১৯১৯। ভোরের আলো তখন সবে ফুটেছে, প্রশান্তকুমার মহলানবিশ এলেন কবির কাছে, রাতজাগা ক্লান্ত চোখে আটান্ন বছরের কবি তাঁকে দেখে বললেন, “এই নাও। অবশেষে শেষ করেছি।” বিহ্বল প্রশান্তচন্দ্র দেখেন ইংরেজিতে লেখা একখানা চিঠি, যার মধ্যে রয়েছে সেই অমর পঙ্ক্তিগুলি:
‘অবমাননার এই অসংগত প্রেক্ষাপটে সম্মানের তকমাগুলি আমাদের লজ্জাকেই আরো প্রকট করে তোলে। আমার তরফ থেকে সকল বিশিষ্টতার চিহ্ন ছেঁটে ফেলে আমি পাশে গিয়ে দাঁড়াতে চাই আমার সেইসব তথাকথিত অকিঞ্চিৎকর দেশবাসীর পাশে, অকিঞ্চিৎকরতার মূল্য হিসেবে যাদের এমন অসম্মানের শিকার হতে হল যা মানুষের অযোগ্য’। (The time has come when badges of honour make our shame glaring in the incongruous context of humiliation, and I for my part wish to stand, shorn of all special distinctions, by the side of those of my countrymen, who, for their so-called insignificance, are liable to suffer degradation not fit for human beings.)
সারা দেশের রাজনৈতিক নেতারা যখন কৌশলগত কারণে চুপ, তখন একজন কবি এগিয়ে এসে ভাষা দিলেন পরাধীন দেশের বিবেকী প্রতিবাদকে। পথ দেখালেন রবীন্দ্রনাথ, আর সে পথে হেঁটেই পঞ্জাব এবং উত্তর পশ্চিমভারতের বহু লেখক-শিল্পী সাহিত্যিকের কলমে ভাষা পেল জালিয়ানওয়ালাবাগের যন্ত্রণা, নিহত আহত পরিবারগুলির অন্দরমহলের অভিঘাত উঠে এলো ছোটগল্পে, নাটকে, সংলাপে, ছবিতে। ইতিহাসের বইতে জালিয়ানওয়ালাবাগ একটি ঘটনা মাত্র, কিন্তু অমৃতসরের আশেপাশের বহু মানুষের কাছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাহিত হয়ে সে ঘটনা হয়ে ওঠে চলমান ইতিহাস, যার অভিঘাতে জন্ম হয় বাস্তবতার শিল্প—রক্ষানন্দ জলিল তৈরি করেছিলেন তেমনই একটি জীবন্ত সংকলন গ্রন্থ। হিন্দি, উর্দু আর পঞ্জাবি সাহিত্যিকদের লেখায় জালিয়ানওয়ালাবাগ তাঁর ঘটনাক্রমকে ছাড়িয়ে যেভাবে যন্ত্রণা আর ঘৃণার ছায়ায় হয়ে ওঠে এক গভীর বিষাদের ট্রমা তারই ছবি ধরা পড়ে মুলাক রাজ আনন্দ-এর ‘মর্নিং ফেস’ বা আবদুল্লা হুসেইন-এর ‘উদাস নাসলীন’ উপন্যাসের অংশে। জালিয়ানওয়ালাবাগ-এর জীবন্ত ছবি ধরা আছে সাদাত হাসান মান্টোর ‘an incident in 1919’ গল্পটিতে, ইতিহাসের দিক থেকে এইগল্পটি জালিয়ানওয়ালাবাগের হাড়হিম করা সন্ত্রাসের এক অসহনীয় প্রতিচ্ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে, মনে রাখতে হবে ১৩ এপ্রিলের সেই সন্ধ্যেতে মান্টো অমৃতসরেই ছিলেন, কাজেই ইতিহাস নয়, মান্টোর কলমে রূপ পেয়েছে বাস্তব দৃশ্য, যা আমাদের এই ১০১ বছর পরেও নাড়িয়ে দিয়ে যায়। এরকমই আরেকটি গল্প গুলাম আব্বাস-এর ‘those who Crawled’, কিংবা নভতেজ সিং-এর গল্প ‘Jalianwala comes to Life’— এইসবই তুলে ধরে জালিয়ানওয়ালার স্মৃতি। বহু মানুষের আর্তনাদ আর রক্তের নাম জালিয়ানওয়ালাবাগ। ইতিহাস তাকে ১০২ বছর আগের একটি ঘটনা বলেই জানে, কিন্তু আপামোর ভারতবাসীর কাছে এটি একটি ঘটনামাত্র নয়, মানুষ হয়ে মানুষ মারার এই কর্মযজ্ঞ আসলে সভ্যতার একটি কালো অধ্যায়, যে অধ্যায়ে লেখা রয়েছে কয়েক শো নিরাপরাধ ভারতবাসীর নাম।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন