ওপারের হাতছানি ও মৃত্যুহীন পান্নালাল
পৃথিবীর কেউ ভালো তো বাসে না, /
এ-পৃথিবী ভালো বাসিতে জানে না,/
যেথা আছে শুধু ভালোবাসাবাসি/
সেথা যেতে প্রাণ চায় মা–
গানের কলি কমলাকান্তের হলেও এ-গানকে বাঙালির মরমে বিঁধিয়ে দিয়ে গিয়েছেন যিনি, তিনি শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্য। শুধু শিল্পী বললে অবশ্য ভুল হয়, রামপ্রসাদ-কমলাকান্তদের মতোই পান্নালালও ছিলেন সংসারে এক সাধক। যেভাবে বাংলার শাক্তগানগুলিতে সংসার এবং সাধনার দ্বন্দ্ব উঠে আসে, পান্নালালের সমগ্র জীবন যেন সেই দ্বন্দ্বেরই আকর। স্ত্রী ও তিন কন্যা নিয়ে ঘোরতর সংসারী হয়েও শ্মশানের বৈরাগ্য আর মায়ের দেখা পাওয়ার আবেগে উদ্বেলিত এই মানুষটির জাদু-কণ্ঠে গাওয়া সেই বিখ্যাত গানগুলি, বাঙালির শক্তি আরাধনার আসরে মন্ত্রে মতোই অমলিন। রেকর্ড-ক্যাসেট-সিডির যুগ পেরিয়ে ইন্টারনেট জমানায় দাঁড়িয়েও তাই বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে শ্যামাসংগীত এবং পান্নালাল কার্যত সমার্থক দুটি শব্দ, তাঁর অস্বাভাবিক রহস্যমৃত্যুর অর্ধ-শতাব্দী পরেও।
সঙ্গীত ও ভক্তির উত্তরাধিকার পান্নালাল পেয়েছিলেন পারিবারিক সূত্রেই। শৈশবে পিতৃহারা পান্নালালের কাছে তাঁর বাবা-মা দুইই ছিলেন তাঁর মেজদা, সেকালের সঙ্গীত জগতের প্রবাদ-পুরুষ ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য। শ্যামাসঙ্গীতে তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন তিনিই। পান্নালালের নিজের ইচ্ছে ছিল আধুনিক-গানের প্লেব্যাক শিল্পী হবেন। সেই বাসনা থেকে সরিয়ে মেজদাই তাঁকে দিয়েছিলেন শ্যামাসঙ্গীতের দীক্ষা। বুঝেছিলেন, যে প্রবল ভক্তি-আবেগ পান্নালালের কণ্ঠে আছে, তা শ্যামাগানের জগতে তাঁকে একদিন অমরত্ব দেবে। কার্যক্ষেত্রে হয়েছেও তাই।
পান্নালালের শ্যামাসঙ্গীত গাইবার শুরু ছোটবেলাতেই। পরবর্তীকালে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ এবং যামিনী গাঙ্গুলির মতো প্রখ্যাত সঙ্গীত গুরুদের কাছে শিক্ষালাভের সুযোগ পেয়েও প্রথাগত সঙ্গীত-সাধনার বাঁধনে পান্নালালকে কখনই বাঁধা যায়নি। শেষপর্যন্ত তাঁর স্বভাবিক দরদি কণ্ঠকে তাঁর মেজদাই কিছুটা ঘষা-মাজা করে গাওয়াতেন একের পর এক গান। গানের পাশাপাশি পান্নালালের প্রবল নেশা ছিল মাছধরা, ঘুড়ি ওড়ানো আর ফুটবল খেলার। ফুটবল বলতে অজ্ঞান পান্নালাল ছিলেন মোহনবাগানের অন্ধ সমর্থক। নিজেও ফুটবল খেলতেন। যৌবনে এই ফুটবল খেলতে গিয়েই চোখে মারাত্মক চোট পেয়ে প্রায় অন্ধ হতে বসেছিলেন তিনি। শেষে দেড় মাস চিকিৎসার পর তাঁর চোখ ঠিক হয়ে ওঠে। তবে ডান চোখের মণিটি সামান্য সরে যায়।
বাউন্ডুলে স্বভাবের পান্নালালের বিয়ে হয় ১৯৫৪ সালের ১৪ মার্চ, মঞ্জুশ্রী দেবীর সঙ্গে। তাঁদের তিন মেয়ে–কাজরী, কাকলি ও শর্বরী। এই মেয়েদের জন্য জামা কেনা, তাদের চুল বেঁধে দেওয়া, রান্নার জন্য কুটনো কেটে দেওয়া— নিপাট মধ্যবিত্ত সংসারীর মতো সবই করতেন পান্নালাল। কিন্তু এই সংসার সাধনার মাঝেই পান্নালাল শুনতে পেয়েছিলেন ‘ওপার-এর হাতছানির ডাক’। শুধু পেশার তাগিদে বা জনপ্রিয়তার জন্যে নয়, পান্নালাল মায়ের নামগান করতেন সাধনার চিরপথের পথিক হিসেবেই।
জীবনের শেষ দিকে প্রায়ই শ্মশানে গিয়ে বসে থাকতেন তিনি। কখনও কেওড়াতলা, কখনও সিরিটি, কখনওবা বালির বারেন্দ্র পাড়ার শ্মশান ঘাটে। বসে থাকতেন, আর কাঁদতেন। আপন মনে বিড়বিড় করে বলতেন, “আমি তো চিরকাল ঈশ্বরের গান গেয়ে বেড়ালাম। আমার ঈশ্বর দর্শন হবে না কেন? কেন আমায় দেখা দিবি না মাগো?” এই অসীম বেদনা আর নিরন্তর আকুতির পরিণাম যে শেষপর্যন্ত পান্নালালকে নিয়ে যাবে আত্মহননের পরিণতিতে—তখনও তা অজানা। কিন্তু কিছু ইঙ্গিত যেন মা-ই দিয়েছিলেন শেষ দিকে গাওয়া গানগুলির কথায়!
১৯৬৬-তে শেষ রেকর্ড করা গান “ওপার আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে”। সুর আর কথায় যেন কোন ওপাড়ে হারিয়ে যাওয়ার একটা আকুতি ঝরে পরে গানটিতে। এইসময়েই রেকর্ড করা আরও দুটি শ্যামাসঙ্গীতেও সেই রহস্যময় ইঙ্গিত ফুটে ওঠে। পান্নালালের কণ্ঠে এই গানগুলি যারা শুনেছেন তাঁরা বুঝবেন কি করুন হাহাকার আর বেদনার আর্তি ছড়িয়ে রয়েছে তাতে।
তাঁর শেষদিনটি আজও রহস্যে ও বিস্ময়ে মোড়া।
৬৬-র সেই গান রেকর্ড-এর মাত্র কয়েকদিন পরের ঘটনা। ২৬ মার্চ, ১৯৬৬। রবিবার। কাঁকুলিয়া রোডের বাড়িতে গলায় দড়ি দেওয়া অবস্থায় উদ্ধার হয় পান্নালালের দেহ। কেন আর কীভাবে—সে উত্তর আজও অধরা। মায়ের করুণা লাভের অসহনীয় আকুতির অন্তিম পরিণতি হিসেবেই কি এই আত্মহনন? নাকি ছিল অন্য কোনো রহস্য? উত্তর আজও জানা নেই।
পান্নালালের মৃত্যুর পর দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য ‘পান্নালাল স্মরণে’ রেকর্ড করেছিলেন দুটি গান - ‘থির হয়ে তুই বস দেখি মা’ এবং ‘ত্রিভুবন জয় করিয়া রাবণ’, দুটিই তাঁর নিজের লেখা। সুর করেছিলেন আরেক দাদা প্রফুল্ল ভট্টাচার্য্য। শোকে বিহ্বল ধনঞ্জয়ের কণ্ঠে সে গান শুনলে আজও মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। একটি গানে লিখেছিলেন –
‘মায়ের দুয়ারে যদি দেখো কেউ/গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে/আকুল কণ্ঠে গেয়ে যায় কেহ/মায়েরই অমৃত নাম।/কাছে গিয়ে তাঁর হাত দু’টি ধরে/জেনে নিও দুটি কথা/কেমন আছে সে? কোথায় আছে সে?/কিবা সে দেশেরই নাম ।।’
অন্য গানের কথাগুলি শুনলে আজও রোমাঞ্চ হয়–
‘সত্যি করে বল পাষাণী/রাখলি কোথা তাঁকে?/মুণ্ডমালায় গাঁথলি নাকি/কটিবাসের পাকে।/মা হয়ে তুই রক্ত খাবি/হলি কালের কাল/পান্নাকে তুই খেয়েছিস তাই/হাতে মুখে লাল/তোকে খেয়ে শোধ নোব মা/নাচব তা থৈ থৈ ।।’
একেবারে সরাসরি ‘পান্না’র মৃত্যুর জন্য ‘মা’র কাছে জবাব চাওয়ার এই গানের সঙ্গে মিলে যায় পান্নালালের শেষ রেকর্ডিং-এর একটি গানের কলি, সেই গানে পান্নালাল গেয়েছিলেন – ‘আমার মুণ্ড মা তোর মালায় র’বে/দু’হাত হ’বে কটি বাস/সেই মুখেতে বলব ‘মা’ ‘মা’/সে’হাতে তুই অর্ঘ্য চাস…’
হয়তো এটাই মহাকালের ইঙ্গিত, ইচ্ছাময়ী তারার ইচ্ছা—মায়ের সন্তানের কণ্ঠে হয়তো মাই গাওয়ান এমন গান, যে গানের মধ্য দিয়ে মায়ের পূজার আসরে চিরকালের স্থান লাভ করেছেন পান্নালাল। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে চলে গিয়েও পান্নালাল তাই মৃত্যুহীন।
~
সানু ঘোষ, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা
০৪/১১/২০২১
সানু লেখা খুব ভাল হচ্ছে ।
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ, আপনাদের মতামত সবসময় জানতে চাই। ভালো লাগলে শেয়ার এবং ফলো করবেন।
উত্তরমুছুন