নিধিবনের রহস্যময় লীলা
নিধিবন নিয়ে সরকারি নির্দেশনামা, সূর্যাস্তের পর কারো প্রবেশাধিকার নেই
“আজি নিধুবনে শ্যাম-বিনোদিনী ভোর
দোঁহার রূপের নাহিকো উপমা
সুখের নাহিকো ওর”
অজ্ঞাত পদকর্তার মধুরকান্তি পদাবলীর এই দুটি চরণও স্বীকার করে নিয়েছে নিধুবনের রহস্য। নিধুবন বা নিধিবন—বৃন্দাবনের এক রহস্যময় অরণ্য, যেখানে প্রতিরাতে জেগে ওঠে এক ঐশ্বরিক মায়া। রচিত হয় কৃষ্ণপ্রেমের মিলন-আসর। সখী পরিবৃত হয়ে কৃষ্ণ ও রাধার সেই মধুর মিলনের দৃশ্য জাগতিক নয়, জাগতিক চোখে তাই সে দৃশ্য দেখাও যায় না।
একটা দুটো নয়, আট-আটখানা তালা! সন্ধের অন্ধকার গাঢ় হয়ে নামার আগেই যেগুলি বন্ধ করে দেয় বৃন্দাবনের রঙমহল আর বাঁকেবিহারি মন্দিরের দরজা। বন্ধ হয়ে যায় নিধিবনের ফটকও। সূর্যের শেষ কিরণের দ্যুতি তখন আগত রাতের বন্দোবস্তকে ক্রমাগত তাড়া দিয়ে বলছে—তৈরি হও, তৈরি হও, সময় বেশি নেই আর। মানুষ তো কোন্ ছাড় পশু-পাখিও বোঝে সেই সময়ের ঘোষণা—সন্ধে নামার আগেই তাই নিধিবন ছেড়ে চলে যেতে থাকে তারাও। কেননা সূর্যাস্তের পর এখানে ইহজগতের কোনো প্রাণীরই প্রবেশাধিকার নেই। দিনের বেলায় প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর এই অরণ্যকে মুখরিত রাখে যেসব পাখি; দিনের আলো নিভে আসার আগেই তারাও চলে যায় অন্যত্র, বের করে দেওয়া হয় সমস্ত ভক্ত, দর্শনার্থী এবং পর্যটকদেরও। কিন্তু কেন? অন্ধকার রাতে কী এমন ঘটনা ঘটে বৃন্দাবনের এই অরণ্যপ্রান্তরে? যা চর্মচক্ষে দেখার অধিকার নেই কোনও প্রাণীরই!
নিধি বনের রহস্যময় তুলসীগাছগুলি
পুরাণ অনুসারে বৃন্দাবন কৃষ্ণের জন্মভূমি নয়; কর্মভূমি কিংবা শাসনক্ষেত্রও নয়—বৃন্দাবন শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমি। জন্মের অব্যবহিত পরেই বর্ষণমুখর সেই রাতের অন্ধকারে পিতার সাহায্যে যমুনা পেরিয়ে তাঁর এই বৃন্দাবনে আসা নিতান্তই পূর্বনির্ধারিত লীলা—এখানেই বেড়ে উঠবেন তিনি, শৈশব আর কৈশোরের মধুর রসামৃত লীলার আবাদভূমি হয়ে এই বৃন্দাবনে চিরঅক্ষয় হয়ে থাকবে যমুনার পাড়, কদম গাছ আর তাঁর প্রিয় নিধিবন। সেই দ্বাপর যুগ থেকে আজও অবধি যা রয়ে গিয়েছে একইভাবে। চিরসবুজ গাছে-ঘেরা শান্ত স্নিগ্ধ এই অরণ্য বড়োই প্রিয় ছিল কৃষ্ণের, প্রিয় ছিল রাধারও। এখানেই প্রধান অষ্টসখী আর অন্যান্য গোপিনীদের নিয়ে মধুরমিলনের লীলায় মেতে উঠতেন কৃষ্ণ। ভক্তদের বিশ্বাস আজও সেই লীলা অব্যাহত। আজও প্রতিরাতে এখানে নৈশাভিসার শেষে মিলিত হন রাধা-কৃষ্ণ যুগল। আর সেকারণেই প্রতিদিন সন্ধ্যায় আরতির পরে-পরেই বন্ধ করে দেওয়া হয় নিধিবনের দরজা।
কিন্তু কেমন এই নিধিবন? কেন একে ঘিরে এতো অজস্র কিংবদন্তীর ছড়াছড়ি? নিধিবনের রহস্য, তাকে ঘিরে ঐশ্বরিক প্রেমবিলাসের কাহিনি এইসব কিছুকে ছাপিয়েও নিধিবন বাহ্যতই বড়ো রহস্যময়, বড়োই আশ্চর্য এখানকার পরিবেশ। নিধিবনের সমস্ত চত্বর জুড়ে যে গাছপালা চোখে পড়ে তেমনটা বৃন্দাবনের আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না, কেবল ভিন্ন প্রজাতির গাছই নয়, এইসব গাছের বিস্তারও বড়ো অদ্ভুত। সোজাসুজির বদলে এসব গাছের কাণ্ড আর শাখা বেড়ে চলে পাশের দিকে, নীচের দিকে ঝুঁকে। কোমর অবধি সোজা হয়ে ওঠার পরই গাছগুলির ডালপালার এইরকম পাশের আর নীচের দিকে বাঁক নেওয়া, দেখে মনে হয় যেন মাথা নত করে কারও উদ্দেশ্যে অভিবাদন জানাচ্ছে তারা। এমনিতে বৃন্দাবন শুকনো হাওয়া-মাটির দেশ, কিন্তু নিধিবনের অরণ্যসমাহার যেন এখানের আবহাওয়া-জলবায়ুকেও অগ্রাহ্য করে রচনা করেছে চিরসবুজের রহস্যমায়া—যেন চির যৌবনের অনন্ত রাসলীলার আয়োজনে এখানে থমকে গিয়েছে সময়।
নিধিবনের তুলসীগাছগুলোও নাকি অদ্ভুত রহস্যমণ্ডিত। সর্বত্রই জোড়া তুলসী-গাছ, একক তুলসীগাছ এখানে দেখা যায় না, রাসনৃত্যের যুগল আদলেই প্রতিটি তুলসী গাছই জোড়ায়-জোড়ায়। নিধিবনের ভেতরে রয়েছে আরেকটি দর্শনীয় স্থান—একটি জলাশয়, যার নাম বিশাখাকুণ্ড। প্রবল খরাতেও নাকি শুকোয় না এর জল। কথিত আছে যে রাসনৃত্যের সময়কালে সখী বিশাখার হঠাৎ খুব তৃষ্ণা পায়, তাঁর পিপাসা দূর করতেই নাকি কৃষ্ণ বাঁশির খোঁচায় এই জলাশয়টি সৃষ্টি করেন। বৃন্দাবনের ভক্তদের কাছে এই বিশাখাকুণ্ডের জল তাই অতি পবিত্র।
নিধিবনের প্রান্তেই রয়েছে ‘বাঁকেবিহারী’জীউর মন্দির, যেখানে কালো কষ্টিপাথরের অপূর্ব কারুকার্যমণ্ডিত কৃষ্ণমূর্তিটি ভক্তদের মুগ্ধ করে, দেশের এবং বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে আসেন ভক্তরা, তাঁদের নামগানে সারাদিন মুখরিত থাকে মন্দির প্রাঙ্গণ। কিন্তু সন্ধ্যারতি শেষ হতে না হতেই বদলে যায় ছবিটা। বন্ধ করে দেওয়া হয় মন্দিরের সমস্ত জানলা-দরজা, ভক্ত কিংবা পুজারি, সন্ধের পর এই মন্দিরে থাকার অধিকার নেই কারও। কর্তৃপক্ষের কড়া নির্দেশ অনুযায়ী সূর্যাস্তের পর আর কাউকেই থাকতে দেওয়া হয়না এই চত্বরে। ভক্তদের বিশ্বাস এই আপাত স্বাভাবিক সুন্দর নিধিবনের বুকেই রাতের অন্ধকারে জেগে ওঠে দ্বাপর যুগের ‘সেই নিধিবন’।
প্রতি রাত্রেই নাকি স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, তাঁর হ্লাদিনীশক্তি স্বরূপা মহামায়া রাধিকাকে নিয়ে পা রাখেন এই নিধিবনে। সমস্ত নিধিবন তখন ভরে ওঠে এক আশ্চর্য আলোয়। সারাদিন মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছেরা অপরূপ নারীমূর্তি ধারণ করে তখন। ভক্তেরা বিশ্বাস করে, এই নিধিবনের প্রতিটি গাছই নাকি ছদ্মবেশী গোপিনী। যাঁরা শ্রীকৃষ্ণের দর্শনের আশায় যুগ যুগান্তর ধরে গাছের রূপ ধরে মাথা নত করে তপস্যামগ্ন হয়ে রয়েছে এই নিধিবনে।
রহস্য মায়া লীলা—যে শব্দেই নামাঙ্কিত হোক না কেন, নিধিবনের এই কাহিনি জন্ম দিয়েছে আরও অনেক কিংবদন্তীর। যেমন এই এই নিধিবনের মধ্যেই রয়েছে ‘রঙমহল’ নামের আরও এক আশ্চর্য ছোট্ট মন্দির। বিশ্বাস আর ভক্তির সোপানে এই মন্দিরের ছত্রে ছত্রে অলৌকিকত্বের হাতছানি। কথিত আছে, প্রতিরাতে মহারাস সাঙ্গ করে ক্লান্ত শ্রীকৃষ্ণ রাধার সঙ্গে এই রংমহল মন্দিরেই বাকি রাতটুকু বিশ্রাম নেন। তাই সন্ধের আগেই পূজারিরা এখানে রেখে যান প্রভুর জন্য চন্দনকাঠের পালঙ্ক, জল-মিষ্টি, রাধার জন্য আয়না ও শৃঙ্গারের জিনিসপত্র, খিলি করা পান, দাঁতনকাঠি—এমনই সব খুঁটিনাটি জিনিস। তারপর তালা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় সেই মন্দিরও।
পরের দিন ভোর পাঁচটা নাগাদ যখন সেই মন্দিরের দরজা খোলা হয়, দেখা যায়, বিছানা এলোমেলো, আধখাওয়া মিষ্টি, পান, পড়ে আছে ব্যবহৃত হওয়া দাঁতনকাঠি। সারারাত সেই তালাবন্ধ ঘরে কে বা কারা যেন বিশ্রাম নিয়ে গেছেন!
বৃন্দাবনে কান পাতলেই শোনা যায় নিধিবন নিয়ে এরকমই আশ্চর্য সব কাহিনি। রাতের নিধিবনের রহস্য নিয়ে অনেকরই তীব্র কৌতূহল, কিন্তু সূর্যাস্তের পর সেখানে কারও প্রবেশাধিকার নেই, সরকারিভাবে সেই নিষেধাজ্ঞা লেখাও আছে চারদিকে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করার লোকও আছে, নিতান্ত কৌতূহলে কিংবা অবিশ্বাসে অনেকেই উপেক্ষা করেছেন সেই নির্দেশ। রাতের অন্ধকারে পা-রাখতে চেয়েছেন নিধিবনে, কেউ বা সন্ধের পর লুকিয়ে থেকেছেন গাছের আড়ালে। পরের দিন সকালে তাদের প্রত্যেককেই পাওয়া গেছে অন্ধ, বোবা, উন্মাদ বা অর্ধমৃত বিকলাঙ্গ দশায়। রাতের অন্ধকারে তাঁরা ঠিক কী দেখেছিল সে কথা জানানোর সুযোগ মেলেনি আর। কেবল একজন ভক্তই এর ব্যতিক্রম।
গুরুর মুখে নিধিবনের আশ্চর্য কাহিনি শুনে কলকাতার এক বাঙালি ভক্তের কৌতূহল জেগেছিল রাতের নিধিবনে কী হয় তা স্বচক্ষে দেখার। সেই ইচ্ছে নিয়েই সে পাড়ি দিয়েছিল বৃন্দাবনে। বাঁকেবিহারীর দর্শনের পর পূর্বপরিকল্পনা মতো সে লুকিয়ে থাকে নিধিবনেরই এক ঝোপের আড়ালে। কিন্তু সন্ধেবেলা পূজারিদের হাতে ধরা পড়ে যায় সেই ভক্ত। এভাবে পরপর দু'দিন ব্যর্থ হয়ে তাঁর জেদ আরও চড়ে যায়। তৃতীয়দিন সে এমনভাবে লুকোয়, যে নিধিবনের পাহারাদাররা খুঁজে পায়না তাকে। সন্ধের পর নিয়ম মতোই রঙমহলের খাট সাজিয়ে দরজায় তালা দিয়ে চলে যান পূজারিরা। পরের দিন ভোরবেলা যখন খোলা হয় মন্দিরের দরজা, সেবায়েতরা নিধিবন পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখেন প্রাঙ্গনে অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছেন সেই ভক্ত। সে তখন এতটাই অসুস্থ যে কথা বলার শক্তিটুকুও তাঁর নেই। দ্রুত তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু চিকিৎসায় কোনও সাড়াই দিচ্ছিল না সে।
তবু তাঁর প্রাণ রইল, খবর পেয়ে ঘটনার পাঁচ দিন পর ছুটে এলেন তাঁর গুরুদেব। অসুস্থ শিষ্যকে নিজের আশ্রমে নিয়ে এলেন তিনি। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল সেই লোকটি। ডাক্তারেরাও বুঝতে পারছিল না তাঁর অসুখটা ঠিক কোথায়। একদিন গঙ্গাস্নানে যাওয়ার আগে গুরুদেব তাঁকে দেখতে এলেন, তাঁর কাছে ইশারায় কাগজ-কলম চাইলেন সেই শিষ্য। শিষ্যকে কাগজ-কলম দিয়ে স্নানে চলে যান গুরুদেব। ফিরে এসে দেখেন শিষ্যের দেহে আর প্রাণ নেই। শুধু পাশে পড়ে আছে একটা চিঠি। পরিষ্কার বাংলায় সেই চিঠিতে লেখা ছিল, “গুরুজি, এ কথা আমি কাউকে বলিনি। আপনাকেই বলছি এ কথা। আপনি বলতেন যে নিধিবনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাসলীলা করতে আসেন, কিন্তু আমি সেকথা বিশ্বাস করিনি। আপনার কথা অমান্য করে আমি নিধিবনে গিয়েছিলাম। সেখানে আমি ভগবানের অলৌকিক রূপ প্রত্যক্ষ করেছি। সে রূপ দেখার পর জীবনে আর কিছু চাওয়ার নেই আমার। আমি আর বাঁচতেও চাই না।”
প্রতিরাতে নাকি এমনই রাসনৃত্যে মুখরিত হয় নিধিবন!
এক মৃত্যু-আকাঙ্ক্ষীর এই বয়ান বাংলা ভাষায় রূপ পেয়ে ধরা পড়েছিল এক টুকরো কাগজে, এখনও সে কাগজ সংরক্ষিত আছে মথুরার সংগ্রহশালায়, আর আছে নিধিবনের রহস্যময় লীলা। জাগতিক ভারতবর্ষের কলিযুগের অন্ধকারেও যেখানে প্রতিরাতে বিচ্ছুরিত হয় এক মায়াবী আলোর লীলা—যুক্তির পরতে যাকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিতে পারেনি বিজ্ঞানও। মাটি পৃথিবীর বুকে এই নিধিবনে প্রতিরাতে জাগরিত হয় এক ভিন্ন সময়, ভিন্ন লোক। ইহজগতের কোনও মানুষ সেই সময়কালে যাওয়ার অধিকারী নন, অথবা গেলেও ফিরে আসার চেষ্টা যারা করেছেন তাঁরা সেই অদ্ভুত অনিত্য সময়ের কাছে ফেলে এসেছেন তাঁদের বোধ কিংবা প্রাণ। এসবই বিশ্বাস আর ভক্তির উৎসারণ—এই নিয়েই নিধিবন, অপার রহস্যের লীলাভূমি হয়ে যা আজও জেগে ওঠে প্রতিরাতে।
________________________
সানু ঘোষ, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা
১৮.১১.২১
নিধিবন/ নিধুবনের এই গল্প আমরা অনেকেই জানি। ভাবলে আশ্চর্য লাগে একুশ শতকের এই পৃথিবীতে কত আশ্চর্য জিনিস আছে...
উত্তরমুছুনএকেবারেই তাই, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
উত্তরমুছুন