হেস্টিংস হাউসে আজও সাহেবি ভূতের আনাগোনা!

 


হেস্টিংস হাউস

আছে না নেই? মানে ভূত আছে না নেই? এটাই যাবতীয় ভূতের গল্পের মূল প্রশ্ন। আছের দিকেই পাল্লা ভারি। নইলে গল্প জমে না। ভূত যে আছে সে বিষয়ে অকাট্য প্রমাণ আর যুক্তি বুনেই এগিয়ে চলে সেইসব গল্প, অবিশ্বাসীদের মনে বড়োসড় ঘা খাইয়ে গল্পের শেষে ঘোষণা হয় ‘আছে আছে, সব আছে…’। ভূতের এই থাকা না থাকার উপর অবশ্য ভূতের ভয় কিংবা ভূতের গল্প নির্ভর করে না, বাঙালির আড্ডার আসরে দু’এক জন এমন লোক থাকবেই, যাঁদের ভূত দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে, এবং সে গল্প রোমাঞ্চ মিশিয়ে চা-এর আসরে বলা হবে, এ একেবারে অবধারিত কালচার। ভূতেরা এমনিতেই চিরজীবী, কাজেই এই যে শহর বদলাচ্ছে, পরিবেশ বদলাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে ভূতেদের সনাতন ঠিকানা— ভূতুড়ে বাড়িগুলির চেহারা যাচ্ছে বদলে— ভূতেদের সেই ক্রাইসিস নিয়ে মজাদার বাংলা সিনেমার হতে পারে বটে কিন্তু সমস্যার সমাধান এতে হয় না। কলকাতার ভূতসমাজে সাহেব মেম ভূতেদের ‘ভারত ছাড়ো’ বলে খেদানোর কোনও উপায় কিন্তু নেই, তাঁরা ছিলেন, তাঁরা আছেন, এবং তাঁরা থাকবেনও। 

মহামান্য হেস্টিংস বাহাদুরের স্বনামধন্য ভূতটির কথাই ধরা যাক, তিনি যে এখনও বহাল তবিয়তেই আছেন সেকথা কলকাতার আলিপুর অঞ্চলে পা দিলেই শোনা যায়। আলিপুর সেন্ট্রাল জেল পেরিয়ে গোপালনগরের জর্জকোটের দিকে যেতেই প্রাসাদোপম হেস্টিংস হাউস— মহামান্য ওয়ারেন হেস্টিংস সাহেবের প্রাসাদ। কলকাতার ভূতুড়ে বাড়ির তালিকায় এই বাড়ি রয়েছে একবারে প্রথম সারিতে। এককালে এখানেই বাস করতেন বাংলার প্রথম গভর্নর জেলারেল, ওয়ারেন হেস্টিংস, একা নয়, সস্ত্রীক। এই বাড়িতে এখনও তাঁরই দোর্দণ্ডপ্রতাপ ভূতের আনাগোনার গপ্পো আজও অনেকের মেরুদণ্ডে শিহরণ জাগায়। 

সুদৃশ্য এই বাড়িটির চারপাশে ফাঁকা মাঠে যখন গভীর রাত্রির স্তব্ধতা থমথম করে, তখন রাত্রির সেই তরল অন্ধকারের মাঝে এগিয়ে আসে এক টুকরো ঘন কালো ছায়া। বাড়ির সামনের বনপথকে মথিত করে, শুকনো পাতায় শব্দ তুলে একখানা চারঘোড়ায় টানা অদৃশ্য জুড়িগাড়ি এসে থামে হেস্টিংস হাউসের গাড়ি-বারান্দার নিচে। লাট সাহেবের ভূত বলে কথা। অতএব তেমনই তাঁর দাপট! 

খটাং করে দরজা খুলে তাঁর থেকে নামেন কেউ, গাড়ি থেকে মাটিতে পা রাখার প্রথম পদক্ষেপের সেই বুটের শব্দও নাকি স্পষ্ট শোনা যায়। একটি অস্থির প্রেতছায়া এরপর এগিয়ে যায় সামনে, বাড়ির আশেপাশের ফার্নবীথির ঝোপে, মাধবীলতার কুঞ্জে ঝুঁকে পড়ে সে কি যেন খোঁজে। রাত বাড়ে। আকাশের তারাগুলো উজ্বল হয়ে কেমন ধকধক করে, ফিকে জ্যোৎস্নার আলো গাছগাছালি ঘেরা বিশাল মাঠটাকে যেন আরও ভৌতিক করে তোলে। তারই মাঝে সেই ছায়াদেহ যেন একটা নিদারুণ যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে একবার যায় ইউক্যালিপটাস গাছটার নিচে, আবার ছুটে যায় শালবীথির অন্ধকারে। কোথাও সে পায়না তাঁর হারানো জিনিস। 

এইবার সে হয়ে ওঠে আরও অস্থির, আরও বিক্ষুব্ধ। সশব্দে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে দোতলায়। বড়ো হল-ঘরটার সামনে এসে সে কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায়। এখানেই তো পিয়ানো বাজত। ডিনার শেষে প্রিয়তমার বাহুলগ্না হয়ে ঈষৎ নাচের তালে…কোথায় গেলো সেইসব দিন? নিকষ অন্ধকারে হাতড়ে ফেরে স্মৃতি, দুশো বছরের ওপার থেকে এসে দাঁড়িয়েছে সেই ছায়ামূর্তি, হঠাৎ তাঁর মনে পড়ে এখানে সে এসেছে খুঁজতে, তাঁর হারিয়ে যাওয়া জিনিসগুলি কোথায়? কোথায় সেগুলি? তারপর সেই বিশাল প্রাসাদের প্রতিটি ঘর তন্ন তন্ন করে কি জানি খুঁজে বেড়ান মহামান্য হেস্টিংস সাহেবের অদৃশ্য অবয়ব। বদ্ধ উন্মাদের মতো তাঁর সেই ছুটে চলা। কোনও মহামূল্যবান বস্তু কি তিনি এই বাড়িতে ফেলে গিয়েছিলেন? যার খোঁজেই প্রেতলোক থেকে তাঁর এই নিত্য ছুটে আসা?           

সেকালের লোকজন অবশ্য বলত অন্য কথা, “হবে না, সামান্য কারণে নন্দকুমারের মতো ব্রাহ্মণসন্তানের ফাঁসির হুকুম দিয়ে দিলেন, সেই পাপ কি এমনই যাবে! দুটো গির্জে গড়ার চাঁদা দিলেই বুঝি ব্রেহ্মহত্যার পাপ ধুয়ে যায়! যেনে রাখো, ও পাপের মুক্তি নেই!” 

এখন এসব কাহাবতকে নিছক জনশ্রুতি বলে উড়িয়ে দেওয়াই যায়, কিন্তু সেই ইংরেজ আমল থেকে শুরু হয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত— হেস্টিংস হাউসকে ঘিরে এত মানুষের এত অভিজ্ঞতা হয়েছে যে ‘সব ঝুট হ্যায়’ বলে দেওয়ার মতো হিম্মত হয়না। শোনা যায় জুড়িগাড়ি হাঁকিয়ে তাঁর সেই আসার কথা শুনে রীতিমতো ভড়কে গিয়েছিলেন আরেক ক্ষমতাবান ইংরেজ সাহেব— লর্ড কার্জনও। তাঁর মতো জাঁদরেল পুরুষও বলেছিলেন ‘হেস্টিংস সাহেবকে না ঘাঁটানোই ভালো’—। জানা যায় কার্জনের সাহেবের থাকার বন্দোবস্ত একসময় করা হয়েছিল তাঁরই পূর্বসূরির এই বাড়িটিতে, কিন্তু জনশ্রুতির খবর তাঁর কানে গিয়ে পৌঁছলো। তারপর সেখানে গিয়ে পাহারাদারদের সঙ্গে কথা বলে কার্জন সাহেব সভয় ঘোষণা করেছিলেন— যেখানেই হোক থাকব, কিন্তু হেস্টিংস হাউসে থাকব না। 

সেই থেকে কেউই এখানে থাকেনি, থাকেনা। কালীঘাটের ছোটো গঙ্গা, মানে আদি গঙ্গার পারে এক সময় ছিল বিস্তীর্ণ বস্তি এলাকা, এখনও তার খানিকটা আছে বর্তমান। এককালে সমগ্র এলাকাটাই ছিল জঙ্গল আর বস্তি। তারই খানিকটা উচ্ছেদ করে ১৭৭৭ সাল নাগাদ হেস্টিংস বানিয়েছিলেন তাঁর এই বিশাল হৌস। একান্তই তাঁর নিজের, আর কারও নয়। ব্রিটিশ সরকারের পরবর্তী রথী-মহারথীরাও এড়িয়ে গিয়েছেন এই বাড়িটিকে। বদলে নেটিভ কেরানিদের ঠেলে দিয়েছেন সেখানে, এককালে আপিস হয়েছে বাড়িটির কিছু অংশে। এখন অবশ্য বাড়িটির খানিক অংশে রয়েছে মেয়েদের বি এড কলেজ, হস্টেল। তাঁদের মুখে মুখেও আজও ছড়িয়ে চলেছে দুপুর-রাতে হেস্টিংস সাহেবের হন্যে হয়ে কিছু এক অমূল্য জিনিস খুঁজে ফেরার কাহিনি— 

কিন্তু কেন ঘটে এই অশরীরী আগমন? হেস্টিংস সাহেবের মৃত্যু তো ঘটেছিল ইংল্যান্ডে, তাও স্বাভাবিকভাবে, ১৮১৮ সালে ৮৬ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যুর পর যথাবিধ নিয়মে ডেলসফোর্ড চার্চের অদূরে তাঁকে সমাধিস্থও করা হয়। তাহলে কীসের টানে সুদূর বিলেত থেকে এই শহরের একদা বাসভবনে ছুটে আসেন মিস্টার হেস্টিংস? ইতিহাসের কারবারিরা সাহেবের চিঠিপত্র, দলিল–দস্তাবেজ, ডায়ারি ইত্যাদি হাতড়ে খোঁজা ও বোঝার চেষ্টা করেছেন এর উত্তর। সাহেব ভূতের কী সেই অপূর্ণ বাসনা, যদি জানা যায়, কীসের টানে তাঁর এই প্রত্যহ প্রেতলোক থেকে আনাগোনা। সেটা উদ্ধার করে না হয় পৌঁছে দেওয়া যাবে যথাস্থানে। আর তাতে যদি মুক্তি পান মহামান্য হেস্টিংস সাহেবের বিদেহী আত্মা। সেই অক্ষয় সম্পদের জন্য খোঁজ শুরু করেছিলেন ইংরেজ ঐতিহাসিকরাই। তেমন একটি চিঠির খোঁজও পাওয়া গেছিল— প্রভু হেস্টিংস তাঁর প্রাক্তন পিএ নেসবিট টমসনকে একটি চিঠিতে লিখছেন, 

বারে বারে আমার দপ্তরের কথা উল্লেখ করতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত। কিন্তু আপনার বা লারকিনসের কাছ থেকে এ বিষয়ে এখনও কোনো সংবাদ পেলাম না। এ নিয়ে আমি যে কী উদ্বেগের মধ্যে আছি তা আপনারা কল্পনা করতে পারবেন না।        

বোঝাই যাচ্ছে কোনো এক বিষয়ের সংবাদ না পেয়ে যারপরনাই উৎকন্ঠায় রয়েছেন হেস্টিংস সাহেব। কিন্তু কোন সে বিষয়ে যার জন্য প্রাক্তন পিএ’কেও চিঠি লিখে ব্যতিবস্ত করে তুলেছিলেন সাহেব। উত্তর মেলে ১৭৮৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এর ‘হারানো প্রাপ্তি’ কলমের বিজ্ঞাপনটি দেখলে, তৎকালীন জিজি অর্থাৎ গভর্নর জেনারেলের তরফে প্রকাশিত সেই বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে, 

বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় ওয়ারেন হেস্টিংস মহোদয়ের একটি কালো রঙের বাক্স তাঁর বাসভবন থেকে খোয়া গেছে কিংবা ভ্রমক্রমে তাঁর অন্যান্য অনেক জিনিসের সঙ্গে নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। বাক্সটির মধ্যে দুটি মিনিয়েচার ছবি ও কিছু ব্যক্তিগত কাগজপত্র ছিল। এতদ্বারা জানান যাচ্ছে যে, কোনো ব্যক্তি যদি এমন সংবাদ দিতে পারেন যার ফলে বাক্সটি উদ্ধার করা সম্ভব হবে, মি লারকিনস এবং মি টমসন তাঁকে দুহাজার সিক্কা টাকা পুরস্কার দেবেন।   


কীসের দলিল? কার ছবি? এসব প্রশ্নের উত্তর অধরাই রয়ে গেছে, তবে পুরস্কার মূল্যের বহর দেখে দুয়ে-দুয়ে চার করে নিয়ে ঐতিহাসিকদের অনুমান সেই হারিয়ে যাওয়া বাক্সটিই হল যখের ধন! মহতি হেস্টিংস বাহাদুরের অন্তরের অন্তরাত্মার খুবই কাছের জিনিস সেটি আর তারই সন্ধানে তাঁর প্রেতের রাত-দুপুরে অমন ব্যতিব্যস্ত আনাগোনা। কিন্তু বিজ্ঞাপনই সার— বহু চেষ্টাতেও উদ্ধার করা যায়নি সেই রহস্যময় কালো কাঠের বাক্স। 

বাড়িটি নিয়ে অবশ্য অন্য গল্পও রয়েছে, কেউ কেউ একটি মেম সাহেব ভূতের দেখাও নাকি পেয়েছেন। সুদৃশ্য গাউন পরিহিত, হেঁটে বেড়াচ্ছেন হেস্টিং হাউসের সুবিশাল লম্বা বারান্দায়।  মিসেস হেস্টিংসের এই অশরীরীটি অবশ্য মেয়েদের ক্লাসরুমেও মাঝে মধ্যে উঁকি দিয়েছেন বলে জনৈক ছাত্রীর অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে কারও কোনও ক্ষতি করেননি। মোটের উপর এই হেস্টিংস দম্পতির ভূতজোড়া নিজেদের বাসস্থানে অন্যদের আনাগোনাকে মেনে নিলেও নিজেদের উপস্থিতি এবং অবস্থানকে একেবারে গোপন করতে চান না, স্বছন্দ সহবস্থানে তাঁরাও থাকেন।

টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ছাত্রীদের অভিজ্ঞতা বেশ রোমাঞ্চকর। প্রায়শই তারা শুনতে পান ঘোড়ার ঘুরের শব্দ। আর রাতের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে এক ছাত্রী জানান, ‘একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেছে— হঠাৎ দেখি হলঘরে ঘুরঘুর করছে একটা ছায়ামূর্তি। ভীষণ ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠেছিলাম। সবাই ছুটে এসেছিল, অমনি সেই ছায়া মিলিয়ে গেল’। আর একবার একটি মেয়ে বিএড কলেজটিতে ভর্তি হবে বলে সকাল সকাল চলে এসেছে হেস্টিংস হাউসের চত্বরে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ভোরের ট্রেন ধরে এসে সে অপেক্ষা করছে গাড়ি-বারান্দার নীচে। সদর দরজার ঠিক পাশেই টেবিল-চেয়ারে একটি কোট-প্যান্ট-হ্যাট পরিহিত ভদ্রলোককে বসে থাকতে দেখে মেয়েটি এগিয়ে যায়, একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা কলেজ কখন খুলবে বলতে পারেন? আমি ভর্তি হওয়ার জন্য এসেছিলাম’। লোকটি একমনে সামনে রাখা একটি ইংরেজি কাগজ পড়ছিলেন, মাথা না তুলেই হাতের ইশারায় মেয়েটিকে অপেক্ষা করতে বলে, উঠে চলে গেলেন পেছনের বাগানে। অপেক্ষারত মেয়েটির অপেক্ষা শেষ হল সকাল দশটায়, কলেজ খুলল। জনৈক কর্মচারীকে কথায়-কথায় ঘটনাটি বলতে গিয়ে মেয়েটি বাধা পেল, ‘কি বললে কোট-প্যান্ট-টুপি পরা লোক? ইংরেজি কাগজ পড়ছিল?’ এখানের অভিজ্ঞ কর্মীটি বেশ বোঝেন, ব্যাপারখানা কী! কে ওখানে বসে কাগজ পড়ছিলেন। তবে প্রথম দিন কলেজে ভর্তি হতে এসেই ভূতের সঙ্গে মোলাকাত হয়েছে একথা জানতে পেরে মেয়েটি ভয় পেয়ে যদি আর না আসে, তাই ব্যাপারটা সেই কর্মচারী সেখানেই থামিয়ে দেন। এমন জনশ্রুতি অনেক আছে। আছে আরও অনেক গল্পও। রাতে যে দারোয়ানরা পাহারায় থাকে তারা প্রায়শই নাকি দ্যাখে অন্ধকারের মাঝে জর্জকোর্টের দিকের পাঁচিলের পাশের জঙ্গলে একটা গোলাকার আলো— একটু লালচে ধরণের, কিন্তু বেশ উজ্জ্বল। সেই আলোর গোলকটা একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে, কখনও বা সামনে-পেছনে ঘোরাফেরা করে। মনে হয় যেন কেউ আলো হাতে নিয়ে গাছ-গাছালির সেই জমাট অন্ধকারে কিছু খুঁজছে— যেই তারা দল বেঁধে লাঠি নিয়ে সেই রহস্যময় আলোর দিকে ছুটে যায় অমনি দপ করে নিভে যায় সেই আলো। 

    লোকজন অবশ্য বলে ওখানেই কোথাও মিশে আছে তিনটি অপঘাত মৃত্যুর কালো ছায়া। তিনটি অল্পবয়সী ছেলের দেহ— উইলিয়াম, চার্লস আর জন, তিনজনেই হেস্টিংস-এর দ্বিতীয় স্ত্রী মেরিয়ান ইমহফের প্রথম পক্ষের ছেলে জুলিয়াস ইমহফের সন্তান। হিসেব মতো তারা তাই হেস্টিংসেরই নাতি। দেশে ফিরে যাওয়ার আগে হেস্টিংস তাঁর এই বিশাল সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছিলেন দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রথম পক্ষের ছেলে জুলিয়াসকে। জুলিয়াস থাকতেন এখানেই। আর এখানেই পরপর তিনটি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তাঁর তিন ছেলের— বড়ো ছেলে উইলিয়ামের বয়স যখন দশ তখন সে একদিন এই হেস্টিংস হাউসের কম্পাউন্ডেই খেলছিল। এমন সময় ঝড় উঠল। সেই ঝড়ের ভেতর সে খুব লম্বা আর ঢ্যাঙা একটা ছায়ামূর্তি দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল। সেইদিনই তাঁর প্রবল জ্বর এল। আর সেই জ্বরেই তিনদিন ভুগে তাঁর মৃত্যু হল। পরের ভাই চার্লস একদিন তাঁর আয়ার সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে একটা কুয়োয় পড়ে মারা যায়, তখন হেস্টিংস হাউসের কম্পাউন্ডে একটি কুয়ো ছিল। আর জন মারা যায় অজ্ঞাত আততায়ীর অস্ত্রের আঘাতে। তিন সন্তানকে এভাবে পরপর হারানোর যন্ত্রণা জুলিয়াসকেও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়, হেস্টিংস হাউসের চত্বরেই কোথাও একটা রয়েছে তাঁদের সমাধি, ঠিক কোন জায়গায় সেটা অবশ্য হারিয়ে গিয়েছে সময়ের ব্যবধানে। মধ্যরাতের সেই আলোর গোলক কি সেই অকাল মৃতদের সমাধি ঘিরেই রচনা করে অতীন্দ্রিয় মায়া? কে জানে। 

তবে বিধিসম্মত সতর্কীকরণের মতো জানিয়ে রাখি, আমরা কিন্তু মোটেই ভয় দেখানোর জন্য এসব বলছি না, এসবই শোনা কথা— দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা এইসব লাটসাহেবী ভূতের কিসস্যা যে হ্যালুসিনেশনের আলোকধাঁধাঁয় আরও খানিকটা ফুলে ফেঁপে উঠেছে—সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে ব্রিটিশ সাহেবদের প্রাণের শহর কলকাতা—ছিল তাঁদের সাম্রাজ্যের রাজধানী! খাস লন্ডনের পরই ইংরেজ আভিজাত্য আর আধুনিকতার সুয়োরানি ছিল এই শহর। এখানের মাটির তলায় চিরঘুমের শায়িত রয়েছেন সাহেব-মেমের দল। কয়েকশ বছরের সেই পুরনো নাগরিকদের কেউ কেউ যে মাঝে মধ্যে হাওয়া খেতে বেরোন না সেকথা কিন্তু জোর দিয়ে বলা যায় না… ভাগ্যলিপিতে লেখা থাকলে হয়তো এমন কোনও পুরনো বাসিন্দার সঙ্গে আপনার দেখা হতেই পারে। সেই শাহী সাক্ষাৎকে নেহাত কাকতালীয় ঘটনা বলে না হয় উড়িয়ে দেবেন। কি বলেন?

_____________________________


সানু ঘোষ, বাঁশদ্রোণী কলকাতা

০৩.১১.২০২১





ওয়ারেন হেস্টিংস

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চোদ্দ ভূতের আসরে

পার্টিশনের জীবনভাষ্য: প্রজন্মান্তরের খোঁজ

বুদ্ধের পুতাস্থি: রাখা রয়েছে কলকাতাতেই