পার্টিশনের জীবনভাষ্য: প্রজন্মান্তরের খোঁজ






তাহলে কি তাত্ত্বিক স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে বাঙালির দেশভাগ? – প্রশ্নটি উত্থাপন করেছিলেন কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায় তাঁর রক্তমণির হাড়ে: দেশভাগের গল্প সংকলন —এর সম্পাদকীয় ভূমিকায়। নিজের মতো করে প্রশ্নটির উত্তরও দিয়েছেন তিনি, কিন্তু আমাদের আলোচনায় সেই প্রশ্নটিকে আমরা আরও একবার উত্থাপন করলাম তার উত্তর নিয়ে পুনর্বিবেচনার উদ্দেশ্যে নয় বরং প্রশ্নটির প্রশ্নত্বকেই খারিজ করে দিয়ে আমরা তাকে পড়তে চাইছি একটি মন্তব্য আকারে। যে-মুহূর্তে এটিকে মন্তব্য আকারে দেখব সেই মুহূর্তেই এটি আমাদের দেশভাগ চর্চার অভিমুখ প্রসঙ্গে একটি ইঙ্গিতকে স্পষ্ট করে তুলবে। 

   বস্তুত একথা স্বাভাবিকভাবেই মানতে হবে যে ’৪৭-এর দেশভাগকে যখন এই মুহূর্তে, একবিংশ শতাব্দীর প্রজন্ম ফিরে দেখবে তখন তার সেই ‘দেখা’র একটা বহুমুখী তাত্ত্বিক নির্মাণ থাকবেই। কেননা এই প্রজন্মের কাছে দেশভাগ ‘প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা’ নয়; কাজেই কেবল ইতিহাস খুলে বসলেই তার অভিঘাতকে ছোঁয়া যাবে না। বরং রাজনৈতিক, সমাজতাত্ত্বিক, ধর্মীয় ইত্যাদি নানা প্রেক্ষিতে দ্বন্দ্ব-হিংসা-স্বার্থ-সমন্বয় প্রভৃতি নানা মাত্রা থেকে ‘দেশভাগ’ এবং ‘দেশভাগ চর্চা’কে দেখবে এই সময়ের প্রজন্ম। 

এরই সঙ্গে উল্লেখ্য বিশ্বায়ন ও বিশ্বায়নোত্তর পটভূমিতে প্রযুক্তির হাত ধরে আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংযুক্তির ফলে তৈরি হওয়া যে ‘বিশ্ববোধ’ এবং সেই সঙ্গে জীবিকার সন্ধানে বা অন্য কারণে ক্রমশ ‘ঠাঁই-নাড়া’ হতে থাকা একটি প্রজন্মের সময়কাল হিসেবে বর্তমান সময় দেশভাগের মতো একটি ঘটনাকে এবং তার অভিঘাতের নিরন্তর প্রক্রিয়াকে যে নতুনভাবে প্রশ্ন করবে, নতুনভাবে ভাবতে চাইবে, পড়তে চাইবে তা বলাই বাহুল্য। কাজেই এই মুহূর্তে ‘দেশভাগ চর্চা’র চর্চা বহুমুখী ডিসকোর্সে ছড়িয়ে যাওয়া এক বহুস্তরীয়, বহুমুখী আলোচনার ক্ষেত্র। 

একথা ঠিক যে, দেশভাগের মতো গভীর এক রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সমাজতাত্ত্বিক পরিসরের সংঘর্ষের ফলে পার্টিশন তৈরি করেছে ট্রমা। কিন্তু সেই ট্রমার চালচিত্রকে কীভাবে ধরবে শিল্প, কীভাবে ধরবে সাহিত্য-সংস্কৃতি? পার্টিশন ট্রমা, তার বীভৎসতা, তার নীরবতা, তার হিংসা, তার ভেতরের ভাঙাচোরা আখ্যান—এসব পঞ্জাব বা রাজস্থানের সাহিত্যে যেমনভাবে এসেছে বাংলা সাহিত্যে তেমনভাবে আসেনি—এই অভিযোগ বহুদিনের। এমনকি বাংলা সাহিত্যের পরিসরেও পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যে পার্টিশন ত্রিপুরার সাহিত্যের চেয়ে পৃথক। আবার অসমের বাংলা সাহিত্যে পার্টিশনের ছবি বাংলাদেশের পার্টিশন সাহিত্য প্রেক্ষণ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সামগ্রিক পার্টিশন সাহিত্য চর্চায় এই তুলনামূলক পাঠের পরিসরটি সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। 

’৪৭-এর পার্টিশন যে বহু মানুষের মধ্যে ট্রমা তৈরি করেছিল তা নানা ভাবেই অনুধাবন করা যায় সাহিত্যে কিংবা পার্টিশন নথি-পত্রে বহু মানুষের সাক্ষাৎকারের বয়ানে। সেই ট্রমার চরিত্র, ট্রমার বহিঃপ্রকাশ, প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি নিয়েও বহু তাত্ত্বিক কাজ করেছেন, বর্তমান নিবন্ধে আমরা সে প্রসঙ্গে বিস্তারিত যাব না। আমরা কেবল বলতে চাইছি যে, পার্টিশনকে কেন্দ্র করে যে নির্মম বাস্তবতার ছবি, যে ছবিতে অপ্রিয় সত্য হলেও ধরা আছে দুই সম্প্রদায়ের মানুষের রক্তপাত, খুন, ধর্ষণ, চেনা মানুষগুলোর হঠাৎ অপরিচিত হয়ে যাওয়ার যন্ত্রনা, ভেঙে পড়া মূল্যবোধ, বিশ্বাসের মাটি থেকে উৎখাত হয়ে যাওয়ার কাহিনি, এইসব কঠিন সত্যকে ধরে রাখার দায় থেকেই এখনের ‘পার্টিশন চর্চা’ অ্যাকেডিমক প্রবন্ধ, বিদগ্ধ বক্তৃতার পরিসর ছাড়িয়ে ছুঁয়ে যেতে চাইছে প্রান্তিক মানুষের বয়ানকে। তথাকথিত নাগরিক উদ্বাস্তু জনগণের বিপরীতে, শহরতলি, মফস্বল আর সীমান্তঘেঁষা জনজীবনের বয়ানে ‘দেশভাগ’ খুঁজে পাচ্ছে আরও বৃহত্তর বিস্তার। কেন্দ্র বনাম প্রান্তের বিতর্কের সঙ্গেই শহর আর শহর-নির্ভর অর্থনীতির বিচ্ছুরণে উদ্বাস্তু মধ্যবিত্তের কলোনি-কালচারের পাশেই সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের জেলা, জেলাশহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামে এসে ওঠা অতি-সাধারণ উদ্বাস্তু মানুষের চেতনায় কীভাবে ধরা থাকে দেশভাগ, কীভাবে বোনা হয় ফেলে আসা দেশের জলছবি, কেমন ছিল সেই পার্টিশন-মুহূর্ত—সাম্প্রতিক গবেষণার অভিমুখ এখন সেই দিকেই।    

তারই সঙ্গে সাম্প্রতিক পার্টিশনচর্চা আমাদের জানায়, কীভাবে বিভক্ত বাংলার প্রেক্ষাপটে পার্টিশন তার তাৎক্ষণিক বাস্তবতায় দাঙ্গা, রক্ত আর ঘৃণার প্রেক্ষাপটকে ছাপিয়ে গিয়ে বড়ো করে তুলেছিল উদ্বাস্তু জনজীবনের সংগ্রাম, স্মৃতি আর ফেলে আসা বিশ্বাসের, ফেলে আসা মাটির গন্ধকে, যাকে সে চাপা দিয়েছে অনেক কষ্টে, অনেক অনেক রক্তপাতে। কেন সাহিত্যের পাতায় সেই কষ্টকে পুনঃজাগরূক সে করেনি, করতে পারেনি কিংবা করতে চায়নি তার উত্তরের চেয়েও বড়ো হয়ে ওঠে পার্টিশনকে বহন করার এই স্মৃতিময় যাপন। ঊর্বশী বুটালিয়ার একটি বিখ্যাত উক্তি এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে: 

Partition was difficult to forget, but dangerous to remember. 

এই “Dangerous to remember” কথাটির মূলে লেগে থাকে যে বেদনা, যে যন্ত্রণা তার বিশ্লেষণই উত্তর প্রজন্মের পার্টিশন ভাষ্যের মূল উপজীব্য। বর্তমান পার্টিশনচর্চা তাই আমাদের দেখায় পঞ্জাবের মতো দেশের পশ্চিমপ্রান্তের পার্টিশন প্রভাবিত রাজ্যগুলির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ-অসম-ত্রিপুরার মতো দেশের পূর্বপ্রান্তের পার্টিশন প্রভাবিত রাজ্যগুলির ’৪৭ পরবর্তী রাজনৈতিক সমাজতাত্ত্বিক পটভূমির ফারাকটি কীভাবে বদলে দেয় পার্টিশনের অভিঘাতকেই, পার্টিশনের সংজ্ঞাকেই। ‘বেঙ্গল পার্টিশন’-এর চর্চায় ‘উদ্বাস্তু’ আইডেন্টিটিও এর ফলে হয়ে ওঠে বহুস্বরিক। সাধারণভাবে সেইই উদ্বাস্তু যে হারিয়েছে বাস্তু, আর উদ্বাস্তু সেই মানুষের ছিন্নমূল জীবন, তার ট্রমাটিক চেতনা, ভাগের রাজনীতি, ভাগের ইতিহাস, ভাগের সমাজতত্ত্ব—এই সবকিছু নিয়ে পার্টিশনচর্চা এখন ছুঁয়ে যাচ্ছে নতুন-নতুন দিক।   

বস্তুত পার্টিশন কোন ইভেন্ট নয়; এটি একটি প্রসেস—বহমান প্রক্রিয়া, যার ‘প্রলম্ব ছায়া’ (Urvashi Butalia ব্যবহার করেছেন ‘Long Shadow’ শব্দবন্ধটি) থেকে এখনও বেরিয়ে আসতে পারিনি আমরা। কাজেই সেই প্রসেস, সেই প্রক্রিয়াকে সাংস্কৃতিক প্রতিস্থাপনে পৃথক একটি পরিসর হিসেবে চিহ্নিত করা হবে কীভাবে? কী নামে? কী হবে সেই পরিসরের পরিধি? দেশভাগ চলাকালীন বা অব্যবহিত পরবর্তী কাঁটাতার পেরোনোর আখ্যানেই কি সীমায়িত হবে তার পরিসর? নাকি তারও বহু পরের ছিন্নমূল উদ্বাস্তু জীবনের ট্রাম-বাস-কলোনির বা ছোটো ঘরের সংসারের কাহিনিও হয়ে উঠবে পার্টিশন আখ্যান? মোটা দাগে পার্টিশনকে এইভাবে চিহ্নিত করার মূলে কাজ করে যায় বিষয়কেন্দ্রিকতার ঝোঁক। এবং সেই ঝোঁকের ফলে পার্টিশন আলোচনার পরিসরে উঠে আসতে পারে না উদ্বাস্তু জীবনের ফাঁকফোকরে চলতে থাকা বহমান পার্টিশনের, প্রসেসরূপী পার্টিশনের ছোটো ছোটো আখ্যানগুলি। বরং বারবার স্মৃতির সূত্র ধরে ফেলে আসা দেশ-মাটির কাতরতায় ভরে গিয়ে পার্টিশন হয়ে ওঠে স্মৃতির এপিটাফ। স্মৃতির নির্মাণ। 

পার্টিশন সাহিত্যে স্মৃতির ভূমিকা অনস্বীকার্য। এককথায় পার্টিশন সাহিত্য বা বড়ো অর্থে পার্টিশন সংস্কৃতি স্মৃতিরই অনুলেখ। কিন্তু সাধারণ স্মৃতি থেকে ইতিহাসের যে নির্মাণ প্রক্রিয়া, পার্টিশন সত্তার ট্রমাটাইসড্‌ স্মৃতি থেকে সেই একই প্রক্রিয়ায় ইতিহাসের নির্মাণ কার্যত অসম্ভব। কেননা ভাগের ইতিবৃত্তে ধর্ম-ভাষা-জাত-কৃষ্টি কত না সূত্রে আমাদের পার্টিশন সমীকরণটি বিভাজিত, কাজেই সেই বিভাজনের স্মৃতিও কত না সূত্রে নিজেও বিভাজিত। সেকারণেই পার্টিশন আখ্যানের অভ্যন্তরে বারবার অজান্তেই বিনষ্ট হয় সংস্কৃতিচর্চার অবেজক্টভিটি। 

আগেই বলেছি আমাদের পার্টিশন চর্চায় হিংসার রিয়্যালিটির আখ্যান এমনিতেই কম, তুলনামূলকভাবে মেমরি কেন্দ্রিক উদ্বাস্তু জীবন আখ্যানই সংখ্যায় বেশি। স্মৃতির মধ্য দিয়ে প্রাত্যহিক যাপনে কোনো এক ফেলে আসা দেশ, যে দেশ আসলে হয়তো তেমন ছিল না যেমনটা এখন স্মৃতির বুননে তাকে সাজাচ্ছি, তবু সে দেশ, স্মৃতির হাত ধরে মননের মাঝে হয়ে ওঠে ‘আমাদের দেশ’, ‘আমাগো দ্যাশ’। এই নির্মাণে যেমন মিশে থাকে বিগত ঘৃণা, অসম্পূর্ণ আক্রোশ, অসহায় কান্না, শিকড় ছিঁড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা, তেমনই মিশে থাকে এখনের ছিন্নমূল প্রজন্মের কাছে, কলোনির ঘুপচি ঘরের ভিতর নোয়ানো মাথার হঠাৎ বিগত সুখের এক নিরর্থক অহং। এ প্রসঙ্গে অনেকেরই মনে পড়বে উদ্বাস্তু বাঙালদের কথা, দেশের বাড়িতে প্রভূত ধন সম্পত্তি না হলেও ভিটেমাটি ছেড়ে চলে এসে এখন এক ‘তাড়া-খাওয়া’ নিম্নবিত্ত জীবন কাটানোর বেদনার্ত আখ্যানকে “তোরা তো সব ওদেশে জমিদার ছিলিস” ব্যঙ্গে বহুবার ভেঙে যেতে দেখেও ওই বিগত নিরর্থক অহংকে, অনেক ক্ষেত্রে মিথ্যে অহংকে, আঁকড়ে ধরার মধ্যে যে গভীর এক বিষাদ আছে তাকে সমাজতাত্ত্বিকভাবে বুঝে উঠতে না পারলে অসম্পূর্ণই থেকে যাবে আমাদের পার্টিশন তথা উদ্বাস্তু চর্চা।  

স্মৃতির এইসব নির্মাণ প্রত্যক্ষত যে প্রজন্মের সান্নিধ্যে ঘটে সেই প্রজন্মকে ছুঁয়েই বেড়ে ওঠে তার উত্তরপ্রজন্ম—“পার্টিশন যাদের কাছে যাপিত বাস্তব নয় অথচ যাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পার্টিশন তাদের অভিজ্ঞতায় নেই ও আছে— যুগপৎ।” যুগপৎ এই থাকা ও না-থাকার মিশ্রনে উত্তরপ্রজন্মের কাছে পার্টিশন হয়ে ওঠে ‘স্মৃতির স্মৃতি’। 

মেমরি থেকে পোস্ট মেমরির এই যাত্রাপথে পার্টিশনকে উত্তরপ্রজন্ম ধারণ করে তার সত্তায়। কলোনির বাসাবাড়ি থেকে টুবিএইচকে ফ্ল্যাটে উঠে এসেও যাপনে-সঙ্গোপনে বহমান থাকে সেই পরিচয়। ভিড়ে মিশে যেতে যেতেও আলতো একটা-আধটা কথায়, উচ্চারনে, বাক্‌ভঙ্গিতে, রান্নার স্বাদে, পার্বণে, উৎসবে, অভিমানে, ঘৃণায় হঠাৎই উঁকি দিয়ে যায় পার্টিশনের কাঁটাতার পেরোনোর দাগ। স্মৃতির উত্তরাধিকারে ছোটোবেলা থেকেই পারিবারিক আলোচনায় বহুবার শোনা সেই মেমরি কীভাবে উত্তরপ্রজন্মের সামনেও রেখে যায় পার্টিশনের চালচিত্র তা বহু তাত্ত্বিক দেখিয়েছেন তাঁদের আলোচনায়। 

পার্টিশন-চর্চায় উত্তর-প্রজন্ম তাই নতুনভাবে নতুন দৃষ্টিতে নির্মাণ করছে এক নতুন ভাষ্য। ১৯৪৭-এর পার্টিশনকে তারা আলাদা করে না-দেখে দেখতে চায় উপমহাদেশের ঔপনিবেশিক পর্বের ধারাবাহিক রাজনীতির পরিসরে। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ, ১৯৪৭ সালের দেশভাগ এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টিকে একই সূত্রে, একই ধারাবাহিকতায় গাঁথতে চেষ্টা করছে এখনের পার্টিশন-চর্চা। সাম্প্রতিক ঘটনাবলির নিরিখে ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি ইত্যাদি বাঙালি জাতিসত্তার বিষয়গুলি নতুন-নতুন মাত্রা অর্জন করছে। ফলে উপমহাদেশের তিনটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রেই কেবল নয়, ভৌগোলিক সীমার প্রেক্ষিতে জেলাভিত্তিক, সীমান্তভিত্তিক কিংবা একেবারে স্থানীয় পরিসরেও দেশভাগের ইতিহাস পৃথক এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পর্যবসিত হচ্ছে। রাষ্ট্রের পরিচয়ে সার্বিকভাবে দেশভাগের কোনো একটি প্যাটার্নের কথা এখন আর ততটা প্রাসঙ্গিক থাকছে না, বরং ব্যক্তি অভিজ্ঞতায় বদলে যাচ্ছে পার্টিশনের তাৎপর্য। নানা স্বরক্ষেপের সেই বিচার উত্তর-প্রজন্মের পার্টিশন-চর্চাকে করে তুলেছে অনেক বেশি সূক্ষ্ম এবং গভীর। পার্টিশন সাহিত্য ও সমালোচনা তাই এখন তুলে আনতে চাইছে আড়ালে রয়ে যাওয়া মানুষের না-বলা কথা। উর্বশী বুটালিয়া, কম্‌লা ভাসিন, রীতু মেনন প্রমুখ ঐতিহাসিকরা ১৯৮০-র দশক থেকেই এই কাজটি শুরু করে দিয়েছিলেন, বিশেষ করে সাধারণ মহিলাদের জীবনভাষ্য গ্রহণের মাধ্যমে; গত দু’এক দশকে তা আরও গতি পেয়েছে। এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রান্তীয় জন-গোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া। কিন্তু এই সমস্ত কাজই হয়েছে মূলত পঞ্জাব ও পশ্চিম সীমান্তের পার্টিশনের প্রেক্ষণে। অন্যদিকে বাংলার পার্টিশন, যা এতদিন ছিল অবহেলিত, অতি-সম্প্রতি সেই অবহেলা দূরীভূত হতে শুরু করেছে। সার্ভে, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি গবেষণা মেথড অবলম্বন করে তুলে আনা হচ্ছে প্রান্তিক মানুষের জীবনের পার্টিশন-ভাষ্য। তৈরি হচ্ছে নতুন আকর-সংগ্রহ। এই ধারার গবেষণার নবতম সংযোজন, মননকুমার মণ্ডল সম্পাদিত বই বাংলার পার্টিশন কথা: উত্তর প্রজন্মের খোঁজ (২০২১) এই বইটি নিয়েই এখন আলোচনা করব।

    মননকুমার মণ্ডল সম্পাদিত বাংলার পার্টিশন-কথা: উত্তর প্রজন্মের খোঁজ (প্রস্তাবনা ও ভূমিকাও তাঁর)  বাংলার পার্টিশনচর্চাকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করবে। এই বইতে দেশভাগের ইতিহাসকে শুধুমাত্র ১৯৪৭-এর নিরিখে দেখা হয়নি, বরং পার্টিশনের পরবর্তী অভিঘাতে উপমহদেশের ভৌগোলিক-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিন্যাসকে স্থাপন করা হয়েছে উপনিবেশ পর্বের নবজাগরণ এবং জাতীয়তাবাদ পরিমণ্ডলে, বিশেষ করে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন-পর্বের সঙ্গে। পার্টিশনের এই ‘দীর্ঘ নির্মাণ’ নিঃসন্দেহে উপমহাদেশের ইতিহাসকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে। তবে বইটির মূল আকর্ষণ এর ‘জীবনভাষ্য’ অংশটি। এখানে পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম-মফস্বলে ছড়িয়ে থাকা মূলত সত্তর-ঊর্ধ্ব উদাস্তু সাধারণ মানুষের বয়ানে পার্টিশনের ব্যক্তিক-স্মৃতিকে তুলে ধরা হয়েছে। বিষয়টি কেবলমাত্র বাংলার পার্টিশনচর্চায় নয়, উপমহাদেশের সার্বিক পার্টিশনচর্চায় এক নতুন মাত্রা যোগ করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।  

    বইটি নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পার্টিশন বিষয়ক গবেষণা প্রকল্পের ফসল হিসেবে প্রকাশিত হয়েছেএই প্রকল্পের অধীনে গড়ে উঠেছে একটি ডিজিটাল সংগ্রহশালা যা ভবিষ্যতের গবেষকদের মূল্যবান উপাদান সরবরাহ করবে। সমীক্ষা, সাক্ষাৎকার (অডিও-ভিডিও) এবং একই সঙ্গে সাবেক গবেষণার উপকরণের উপর দাঁড়িয়ে আছে বইটি। গবেষণা প্রবন্ধগুলিও মূলত আর্কাইভ নির্ভর। অধ্যাপক মণ্ডলের সুদক্ষ সম্পাদনা বইটিকে করে তুলেছে নান্দনিক। প্রস্তাবনায় তিনি প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও কর্মপরিধি সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এছাড়াও সুদীর্ঘ ভূমিকায় পার্টিশনচর্চার (বিশেষ করে বাংলার পার্টিশনচর্চার) ধারাবাহিক ইতিহাসকে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। তুলে ধরেছেন উপমহাদেশের পার্টিশনচর্চার পরিধি-পরিসর, দর্শন এবং বদলের অভিমুখগুলি। ভূমিকাটি মূল্যবান, সেইসঙ্গেই পার্টিশনচর্চায় প্রান্তীয় মানুষের জীবনভাষ্যকে বিচার ও গ্রহণের মধ্যে দিয়ে বাংলার পার্টিশনচর্চায় যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নির্মিত হচ্ছে তাঁর নান্দীমুখ হিসেবে ভূমিকাটি আগামী দিনে বিশেষ গুরুত্ব লাভ করবে বলে আমাদের ধারণা। সরকারি মহাফেজখানায় সংরক্ষিত নথি-দলিল, বা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্মৃতিকথা, চিঠিপত্র ও অন্যান্য লেখালিখি নির্ভর ইতিহাস-নির্মিতি থেকে সরে এসে গ্রাম-মফস্বলের অতি সাধারণ মানুষের মৌখিক বয়ানের ভিত্তিতে পার্টিশনকে দেখার এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি—এই বইটির মূল ভরকেন্দ্র। কিন্তু মনে রাখতে হবে বইটি ইতিহাসবিদ্যার প্রেক্ষণে নয় বরং মানববিদ্যার প্রেক্ষণে তৈরি হয়েছে। কাজেই ‘জীবনভাষ্য’গুলি ব্যক্তিস্মৃতির নির্মাণ, প্রত্যক্ষ ইতিহাসের ধারাবিবরণী নয়। একারণেই ব্যক্তির বাস্তু হারানোর গল্প, ব্যক্তির পথচলার কথা, পুনর্বাসন-পুনর্জন্ম থেকে ব্যক্তির ক্ষোভ-দুঃখ-যন্ত্রণা-বিষাদ ইত্যাদি সমস্তকিছুই ঢুকে পড়েছে সেই ‘ইতিহাস’-এর অলিন্দে। বইটি তাই পার্টিশনের ইতিহাস নয়; বরং তুলে ধরে পার্টিশন প্রভাবিত মানুষের জীবন-আখ্যান। ব্যক্তির স্মৃতি-উদ্ভাসনের কাহিনি কখনও ইতিহাসের মতো বস্তুগত হওয়ার দাবী করে না, এই বইটিও সেকথা স্বীকার করে নেয়। একারণেই বইটি পার্টিশনচর্চার পরিসরে যতটা না ইতিহাসের প্রেক্ষিতে উল্লেখযোগ্য তাঁর চেয়ে ঢের বেশি উল্লেখযোগ্য সমাজতত্ত্বের প্রেক্ষিতে। কেননা এতদিন পর্যন্ত পার্টিশনচর্চায় শহর ও শহরের পার্শ্ববর্তী কলোনির কাহিনি প্রাধান্য পেলেও সচেতনভাবেই এই বইটি ছড়িয়ে পড়ে বৃত্তের পরিধির দিকে—মফস্বল ছাড়িয়ে গ্রামে। নিরক্ষর কৃষিজীবী মানুষ হয়ে ওঠে এই বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র।

    বাংলার পার্টিশন-কথা: উত্তর প্রজন্মের খোঁজ তিন খণ্ডে পরিকল্পিত গ্রন্থ, যার প্রথম খণ্ডটি প্রকাশিত হল সম্প্রতি। বাকি দু’খণ্ড আগামীতে প্রকাশিত হবে। প্রকাশিত বইটির প্রস্তাবনায় নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা পরিচালিত প্রকল্পটির বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। প্রকল্পের অধীনে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় প্রায় তিন শতাধিক মানুষের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে। সাক্ষাৎকারগুলির কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথমত সাক্ষাৎকারদাতারা প্রায় প্রত্যেকেই বয়সের নিরিখে সত্তর-ঊর্ধ্ব, তাঁরা মূলত গ্রাম-মফস্বলের মানুষ। ওপার বাংলায় থাকতে তারা যে আর্থসামাজিক পরিসরে বাস করতেন পশ্চিমবঙ্গে এসেও প্রায় সেরকমই পরিসরে, শহর থেকে দূরে—গ্রামে-গঞ্জে বা রেলস্টেশনের পাশে গড়ে ওঠা শহরতলিতে অথবা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে নিজেদের বাসস্থান গড়ে নিয়েছেনদ্বিতীয়ত এঁদের অনেকেই তেমনভাবে শিক্ষার আলো পাননি। দেশভাগের কারণেই শৈশবের পাঠশালা বা প্রাথমিক স্কুলের পর অনেকেরই আর পড়াশোনার সুযোগ হয়নিফলে পার্টিশনের প্রত্যক্ষ প্রভাবকে আজীবন বহন করলেও এঁরা কখনই প্রচলিত সাংস্কৃতিক পরিসরে লিখিত আকারে বা বক্তব্য আকারে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা প্রকাশ করতে পারেননি বা বলা ভালো প্রকাশ করার সুযোগই তাঁদের নেই। সেদিক থেকে এই প্রকল্পই প্রথম তাঁদের বক্তব্যকে পার্টিশনচর্চার অঙ্গনে তুলে ধরে বাংলার পার্টিশনচর্চার এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল। আলোচ্য গ্রন্থটির মূল গুরুত্ব এখানেই। জেলাওয়াড়ি ভাবে মোট তিরিশটি জীবনভাষ্য এই খণ্ডে সংকলিত হয়েছে। যার প্রত্যেকটিই সমান গুরুত্বের দাবীদার।    

যারা সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তাদের অনেকেই সাক্ষাৎকার প্রদানকারীদের পূর্বপরিচিত। কাজেই এগুলি প্রশ্নোত্তর নির্ভর সাক্ষাৎকারের ফরম্যাটকে ভেঙে দিয়ে হয়ে ওঠে ‘জীবনের গল্প’। যে গল্পের মূলে লেগে থাকে একধরণের স্মৃতির অভিঘাত। জীবনভাষ্য অংশের আগে ‘কথামুখ’-এ তাই স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে জীবনের এই স্মৃতিনির্ভর আখ্যান ‘ইতিহাসের সত্য থেকে তা বহুদূর’। পার্টিশন-পীড়িত মানুষের যে জীবনের গল্প সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে মৌখিক বয়ানে সংগ্রহ করা হয়েছে তার এই ‘লেখ্য রূপ’; যাকে সম্পাদক ‘জীবনভাষ্য’ বলেছেন তা কতখানি সেই মৌখিকবয়ানের কাছাকাছি তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। সম্পাদক বিষয়টিকে এড়িয়ে যাননি। বরং বলেছেন: 

আমরা বলছি ভাষ্যরূপ—যা প্রায়শই সাক্ষাৎকার প্রদানকারীর মন-মানসিকতার সমীপবর্তী কিন্তু প্রতিরূপের পূর্ণতা সেখানে নেই। 

তবু বলতে হয় জীবনভাষ্যগুলি সুলিখিত এবং গদ্য অন্বয়ের নিরিখে প্রাঞ্জল। কিছু ক্ষেত্রে প্রথম পুরুষ কথন কিছু ক্ষেত্রে উত্তম পুরুষের কথন আবার কিছু ক্ষেত্রে উভয় প্রকার কথনই প্রয়োজন অনুসারে ব্যবহার করা হয়েছে। রক্ষা করা হয়েছে পূর্ববঙ্গীয় মানুষের বিশেষ বাক্‌ভঙ্গি এবং শব্দের বিশিষ্টার্থ। উদ্বাস্তু এইসব মানুষের ‘জীবনের গল্প’-এ তিনটি ভাগকে বিশেষভাবে লক্ষ করা হয়েছে : শৈশব থেকে যৌবনকাল (পূর্ববঙ্গের স্মৃতি ইত্যাদি); পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাসনের সময়ে গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সম্পর্কে স্মৃতি; ও পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুজীবনের কথা। এভাবে দেশভাগের সময়ের ও তার আগে-পরের আর্থ-সামাজিক জীবনের পর্ব-পর্বান্তর উঠে আসে এই জীবনভাষ্যগুলিতে। উঠে আসে উদ্বাসনের অভিজ্ঞতা, সাম্প্রদায়িক সমস্যার নিগড়ে লেগে থাকা ভিন্ন অভিজ্ঞতার ছবি। নৃশংসতার পাশে পাশে যেখানে উঁকি দিয়ে যায় সম্প্রীতির ছবি। রাষ্ট্রের নির্মিতিকে ছাপিয়ে একেবারে প্রান্তীয় মানুষের অভিজ্ঞতায় ভাস্বর হয়ে ওঠে পার্টিশনের আসল স্বরূপ—কী, কেন, কীভাবে-এর চেয়েও বড়ো হয়ে ওঠে মানুষের জীবনের আশা-নিরাশার গল্প, সব হারিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। প্রতিটি জীবনভাষ্যই তাই উপমহাদেশের পার্টিশন-পীড়িত সাধারণ মানুষের জীবনযুদ্ধের গল্প, যা নিঃসন্দেহে আমাদের অনুপ্রাণিত করবে। 







    প্রবন্ধ অংশে আছে ছ’টি মূল্যবান প্রবন্ধ। এর মধ্যে দু’টি সমীক্ষামূলক। প্রবন্ধগুলি গবেষণাধর্মী এবং কয়েকটি স্পষ্টতই আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত তথ্য-নির্ভর। লোকসংস্কৃতির বিশিষ্ট গবেষক শক্তিনাথ ঝা আলোচ্য গ্রন্থে দেশভাগ ও হিন্দু-মুসলিম বিরোধের প্রেক্ষাপটে বাউল, ফকিরদের অসাম্প্রদায়িক দর্শন এবং প্রতিবাদী মানবিকতার নজির নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। অনিন্দিতা দাশগুপ্ত আলোচনা করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বেতার প্রচারের গুরুত্ব নিয়ে। এই প্রবন্ধটি তৎকালীন সময়ের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার নিপুণ ছবি তুলে ধরে। পাকিস্তানি মিলিটারির সর্বগ্রাসী ধ্বংসলীলার মাঝে বেতার সম্প্রচার কীভাবে সাধারণ মানুষকে সাহস জুগিয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তার তথ্যনিষ্ঠ বিবরণ এই প্রবন্ধে রয়েছে। প্রাবন্ধিক দেখিয়েছেন কীভাবে ‘শব্দসৈনিকেরা’ মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট তৈরি করেন এবং নানা প্রতিকূলতার মাঝেও নিজেদের দায়িত্ব পালন করে যান। সেইসঙ্গেই কলকাতার আকাশবাণী বেতারকেন্দ্রের ভূমিকাও প্রাবন্ধিক উল্লেখ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের গান, বক্তৃতা এবং স্লোগানের উদ্ধৃতি প্রবন্ধটির আকর্ষণ বৃদ্ধি করে।   

    উত্তমকুমার বিশ্বাস বাংলার পার্টিশনের পরিপ্রেক্ষিতে শত্রু-সম্পত্তি সংক্রান্ত আইন ও তার প্রয়োগ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ভারতে ও পূর্ব পাকিস্তানে/বাংলাদেশে বিভিন্ন কেস-স্টাডি তিনি পর্যালোচনা করেছেন, তাদের তুলনামূলক আলোচনা করেছেন এবং সাহিত্যে কীভাবে এর প্রতিফলন হয়েছে তা দেখিয়েছেন। অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য এই প্রবন্ধটি উদ্বাস্তু মানুষের জীবন সমস্যার অর্থনৈতিক দিকটি তুলে ধরে, তুলে ধরে রাষ্ট্রের ভূমিকার কথা। পার্টিশনচর্চায় এই দিকটি ইতোপূর্বে খুব বেশি আলোচিত হয়নি। 

শুভাশিস মণ্ডলের প্রবন্ধ ‘রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন নবপর্যায়’ পত্রিকায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গ’—এই বইয়ের একটি বিশিষ্ট সংযোজনপার্টিশন নিয়ে আলোচনায় ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ প্রসঙ্গকে লেখক স্থাপন করেছেন ইতিহাসের সমীকরণে হিন্দু-মুসলিম আইডেন্টিটির প্রশ্নে। দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথসহ তৎকালীন বাংলার বিদ্বজনদের ভূমিকা।  স্বদেশ নিয়ে তৎকালীন লেখকেরা, যেমন অক্ষয়কুমার মৈত্র, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিপিনচন্দ্র পাল, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখ, বাঙালি জাতিসত্তা ও তার বিভাজনের প্রচেষ্টা সম্পর্কে যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন সেগুলিতে কীভাবে বঙ্গভঙ্গ প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে তার বিশ্লেষণ আছে এই প্রবন্ধে। সেইসঙ্গে সম্পাদক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকাও আলোচনায় এসেছে। প্রবন্ধের শেষে নবপর্যায় বঙ্গদর্শন-এর পাতায় রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের কালে প্রকাশিত স্বদেশভাবনা বিষয়ক লেখাগুলির একটি তালিকা লেখক সংযোজন করেছেন। পার্টিশনের আলোচনায় ১৯০৫-এর সম্ভাবিত বিভাজনের বিরুদ্ধে কেমন ছিল বাংলার সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ, তালিকাটি তারই খতিয়ান তুলে ধরে। ভবিষ্যৎ গবেষণায় এই তালিকা সহায়ক হবে। 

    এছাড়াও বইটিতে রয়েছে দুটি সমীক্ষামূলক লেখা, নদিয়ার কুপার্স মহিলা ক্যাম্প নিয়ে, লিখেছেন প্রদীপ অধিকারী ও দীপিকা মণ্ডল এবং ‘নদিয়া জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম চরমেঘনা ও প্রতিকূল সম্পত্তির জনজীবন’ এই বিষয়ে লিখেছেন অনুদেব মজুমদার। প্রথমটিতে মহিলা কুপার্স ক্যাম্পে যাঁরা এখনও আছেন, তাঁদের সাক্ষাৎকারের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। পার্টিশনের নিবিড় প্রভাবে সারা জীবনই ক্যাম্পে কাটানোর সুখ-দুঃখভরা অভিজ্ঞতা মহিলাদের স্মৃতি-কথায় উঠে এসেছে। অন্যদিকে অনুদেব মজুমদারের প্রবন্ধটি প্রতিবেদনমূলকপার্টিশন তার অভিঘাতের আজন্ম আঁচড় যদি কোথাও রেখে যায় তবে তা সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামগুলিতে, ‘চরমেঘনা’ তেমনই একটি গ্রাম। যে গ্রামের বাসিন্দাদের স্বাভাবিক জীবন চিরকালের মতো বাঁধা পড়ে গেছে সীমান্তের কাঁটাতারে। ভারত আর বাংলাদেশ— জীবন যেখানে মানচিত্রের উপর দাঁড়িয়ে প্রতি মুহূর্তে প্রশ্ন করে রাষ্ট্রকে। চরমেঘনার মানুষের জীবন যন্ত্রণার নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে এই লেখাটিতে, যা নিঃসন্দেহে ভাবায় পার্টিশনের বিষময় বাস্তবতা সম্পর্কে।

    পরিশিষ্টে আছে ‘বেঙ্গল পার্টিশন রিপোজিটরি’র পূর্ণাঙ্গ ক্যাটালগ, নির্দিষ্ট বিন্যাসক্রমে নাম, লিঙ্গ, বয়স, পূর্ববঙ্গের ফেলে আসা গ্রাম/এলাকার নাম, ক্যাম্প জীবনের অভিজ্ঞতা আছে না নেই, সম্পত্তি বিনিময় হয়েছিল কিনা ইত্যাদি নানবিধ তথ্য এখানে তুলে ধরা হয়েছে। মোট ২৮৪ জনের তথ্য সমৃদ্ধ এই ক্যাটালগ, যা কাজে লাগবে ভবিষ্যতের গবেষকদের। বইটিতে মুদ্রণপ্রমাদ দু’একটি চোখে পড়েছে, কিন্তু তা সামান্যই। বইটির প্রচ্ছদ ও পৃষ্ঠাবিন্যাস করেছেন কৌশিক আকী, যা খুবই নান্দনিক হয়েছে। মুদ্রণ ও সম্পাদনাও বিশেষ প্রশংসনীয়। বইটি গবেষক ও সাধারণ পাঠকসমাজে যে যথেষ্ট সমাদর পাবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।   



টীকা ও তথ্যসূত্র: 


১.     দেবেশ রায় (সংকলিত ও সম্পাদিত), ‘দ্বিতীয় সংস্করণ: ভূমিকা’, রক্তমণির হাড়ে: দেশভাগ-স্বাধীনতার বাংলা গল্প সংকলন, প্রথম খণ্ড, নতুন দিল্লি: সাহিত্য অকাদেমি, ২০১৬। 

২.     পূর্বোক্ত।

৩.     Urvashi Butalia, The Other Side of Silence, Penguin, 1998, page 357.

৪.     আব্দুল কাফি, ‘নৈশব্দ্যের গ্রন্থি এবং ‘দেশভাগের সাহিত্য’: সত্তার অনন্ত বিভাজন’, উজাগর পত্রিকা: পার্টিশন মানবাধিকার গণতন্ত্র ও সাহিত্য সংখ্যা, ত্রয়োদশ বর্ষ, প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা ১৪২৩, উত্তম পুরকাইত (সম্পাদিত), হাওড়া, পৃ. ৩৯।


ব্যবহৃত গ্রন্থ ও পত্রিকা: 

১।     অশ্রুকুমার সিকদার, ভাঙা বাংলা বাংলা সাহিত্য, কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, নভেম্বর ২০০৫।

২।     ত্রিদিব চক্রবর্তী, নিরুপমা রায় মণ্ডল ও পৌলমী ঘোষাল (সম্পাদিত), ধ্বংস ও নির্মাণ বঙ্গীয় উদ্বাস্তু সমাজের স্বকথিত বিবরণ, প্রথম সংস্করণ, স্কুল অফ কালচারাল টেক্সট অ্যান্ড রেকর্ডস্‌, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও সেরিবান, কলকাতা।  

৩।    দেবেশ রায় (সংকলিত ও সম্পাদিত), ‘দ্বিতীয় সংস্করণ: ভূমিকা’, রক্তমণির হাড়ে: দেশভাগ-স্বাধীনতার বাংলা গল্প সংকলন, প্রথম খণ্ড, নতুন দিল্লি: সাহিত্য অকাদেমি, ২০১৬।

৪।     মননকুমার মণ্ডল (সম্পাদিত), পার্টিশন সাহিত্য: দেশ-কাল-স্মৃতি, কলকাতা: গাঙচিল ও নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, সেপ্টেম্বর ২০১৪।  

৫।    সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেশভাগ-দেশত্যাগ, কলকাতা: অনুষ্টুপ, জানুয়ারি ২০১০।

৬।    সেমন্তী ঘোষ (সম্পাদিত), দেশভাগ: স্মৃতি আর স্তব্ধতা, কলকাতা: গাঙচিল, অগস্ট ২০১১। 

৭।    উত্তম পুরকাইত (সম্পাদিত), উজাগর পত্রিকা: পার্টিশন মানবাধিকার গণতন্ত্র ও সাহিত্য সংখ্যা, ত্রয়োদশ বর্ষ, প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা ১৪২৩, হাওড়া।


  • বাংলার পার্টিশন কথা: উত্তর প্রজন্মের খোঁজ

প্রস্তাবনা, সম্পাদনা ও গ্রন্থনা: মননকুমার মণ্ডল

প্রকাশক: নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

পরিবেশক: দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা 

রয়্যাল সাইজ। ৩৫২ পৃষ্ঠা। ৫৫০ টাকা। 

















সানু ঘোষ

বাঁশদ্রোণী, কলকাতা

 


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চোদ্দ ভূতের আসরে

বুদ্ধের পুতাস্থি: রাখা রয়েছে কলকাতাতেই