কল্পনাদের মৃত্যু হয় না কখনো
১৯৬২ সালের ১৭ই মার্চ। বর্তমান হরিয়ানার কার্নালে এক ভারতীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিল একটি ছোট্ট মেয়ে। ছোটো থেকে একটু একটু করে বড়ো হতে থাকা মানুষ হাজারও স্বপ্ন দেখে। কল্পনায় সেই স্বপ্নপূরণ হতে চাওয়া মানুষটির বাস্তবও যদি মিলে যায় তবে? মেয়েটিও স্বপ্ন দেখত; আকাশে উড়তে চাওয়ার স্বপ্ন, এরোপ্লেন চালানোর স্বপ্ন। মেয়েরা আবার এইসব করতে পারে নাকি? ঘর সংসারের চিরাচরিত কাঠামোয় তার পরিবার তাকে আটকে রাখেনি। বাবার হাত ধরে ছোট্ট মেয়েটি মাঝেমধ্যেই চলে যেত এলাকার একটি স্থানীয় এরোপ্লেন ক্লাবে এবং অবাক হয়ে দেখত এরোপ্লেনের আকাশছোঁয়া। বাড়ির খোলামেলা পরিবেশ সেই ছোট্ট মেয়েটিকে স্বপ্নপূরণের পথে পা বাড়াতে হয়ে উঠেছিল সিঁড়ির পদক্ষেপ। পাঞ্জাব ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে এয়ারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ব্যাচেলার ডিগ্রি অর্জন করার পর আর পিছনে তাকাতে হল না। স্বপ্নপূরণের অঙ্গীকার গ্রহণে জি বাংলা দায়বদ্ধতা গ্রহণের মতো নয়, একেবারে আমেরিকা থেকে ডাক পড়ল। ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস থেকে এয়ারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স করলেন একদিন উড়তে চাওয়ার স্বপ্ন দেখা হরিয়ানার সেই ভারতীয় মেয়েটি, সালটা ১৯৮২। থেমে থাকা জানত না সে। দ্বিতীয় মাস্টার্স এবং পিএইচডির জন্য গেল ইউনিভার্সিটি অব কলরাডোতে। ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮, আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপন ঘটল তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার।
শুরু থেকেই শেষ হয়। কল্পনারা বাস্তবে বদলে যায় অধ্যবসায়ের মধ্যে দিয়েই। ১৯৮৮ থেকেই নাসায় (NASA) গবেষণা শুরু করে মেয়েটি। CFD কম্পিউট্যাশনাল ফ্লুইড ডায়ানমিকস্ ও V/STOL শর্ট টেক অফ অ্যান্ড ল্যান্ডিংয়ের ওপর গবেষণা চলাকালীন তাঁর বেশ কিছু গবেষণা প্রকল্প বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হতে থাকে। স্বপ্নপূরণের প্রথম ধাপ পূর্ণ হল বিভিন্ন শারীরিক সমস্যাকে অতিক্রম করে। শরীরের থেকেও মনের জোর ও অদম্য ইচ্ছাকে কি ঠেকিয়ে রাখা যায়? ডাক্তারের সার্টিফিকেট পাওয়ার পর সেই মেয়েটি হয়ে উঠল সিঙ্গেল ও মাল্টি ইঞ্জিন এরোপ্লেনের পাইলট! কাহানি আভি বাকি হ্যয়। ১৯৯১ সাল, কাজ ও প্রচেষ্টায় সন্তুষ্ট হয়ে আমেরিকা সরকার মেয়েটিকে নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দিল! মেয়েটি যে কেবল আকাশে থেমে থাকতে চায়নি। তার কল্পনায় ছিল মহাকাশ জয়ের স্বপ্ন। ১৯৯৫-র মার্চ, যে স্বপ্নের ছোট্ট পথচলা শুরু হয়েছিল হরিয়ানায় বাবার হাত ধরে সেই স্বপ্ন সফল হওয়ার দিন। NASA-র নভশ্চর বাহিনীর সদস্য হয়ে উঠল সেই ভারতীয় মেয়েটি, কল্পনা যার নাম।
মহাকাশ জয়ের প্রথম স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পালা। ১৯৯৭ সালের ১৯শে নভেম্বর। ছ'জন নভশ্চর, স্পেস শাটল কলম্বিয়া ফ্লাইটে (STS-87) মহাকাশে পাড়ি দিলেন। প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে মহাকাশ যাত্রায় স্মরণীয় হয়ে উঠলেন কল্পনা, কল্পনা চাওলা। ইতিহাস সৃষ্টি করলেন হরিয়ানার সেই স্বপ্ন দেখতে থাকা মেয়েটি। মহাকাশযানের বায়ুশূ্ন্য কক্ষ থেকে কল্পনার ভেসে আসা কথা সারা বিশ্বের মানুষ শুনতে পেলেন, "ইউ আর জাস্ট ইওর ইন্টালিজেন্স"। পৃথিবীর কক্ষপথে ১০.৪ মিলিয়ন মাইল আবর্তন করলেন ভারতের প্রথম মহিলা নভশ্চর! সময়ের হিসেবে প্রায় ১৫দিন ১২ ঘণ্টা সময় কাটালেন মহাশূন্যে! আশ্চর্য হচ্ছেন, স্বপ্ন হয়তো এভাবেই সফল হয়ে ওঠে। এখানে সবে শুরু, উইনসন স্কট এবং টাকাও ডোইকে সঙ্গে নিয়ে স্যাটেলাইটে থাকা যান্ত্রিক ত্রুটিকে মেরামত করতে সম্পূর্ণ সময় লাগে প্রায় ৫মাস। ভারতীয় মেয়ের এই অভাবনীয় সাফল্যে অচিরেই NASA তাকে টেকনিক্যাল টিমের সদস্য করে নেয়।
সালটা ২০০১, আবার মহাকাশ অভিযান। চাওলা এবারেও নির্বাচিত হলেন আগের প্রোজেক্টের এক্সটেনশনে। হঠাৎ তৈরি হল কিছু যান্ত্রিক সমস্যা। মহাকাশযানের এঞ্জিনে ধরা পড়ল বেশ কিছু ত্রুটি। সমস্ত টেকনিক্যাল ফল্টকে সারিয়ে উঠতে সময় লেগে গেল প্রায় একটা বছর, ২০০২-এর জুলাই পর্যন্ত। ১৬ই জানুয়ারি ২০০৩, সমস্ত বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করে কলম্বিয়া নামক মহাকাশযান পাড়ি দিল মহাশূন্যের পথে। গবেষণার একাধিক বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে শুরু হল কল্পনার দ্বিতীয় সফর, কিন্তু অতি সাবধানী মানুষেরও ভুল হয়। কলম্বিয়া এর আগেও আরও ২৭ বার মহাশূন্যে পাড়ি দিয়েছে এবং যান্ত্রিক ত্রুটিও ধরা পড়েছে; এতসব কিছু সত্ত্বেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সেইবারের সফরেও কলম্বিয়াকেই মহাশূন্যে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় NASA। মহাশূন্যে উৎক্ষেপণের পর দেখা যায়, মেরামতি সত্ত্বেও রয়ে গেছে খানিক গলদ। শূন্যে উড়ানের পরই ট্যাঙ্ক এবং উইংয়ের কাছে কিছু অংশ ভেঙে যায়। নভশ্চারীরা বুঝতে পারেন কিন্তু তখন আর কিছু করা সম্ভব নয়। পরবর্তীতে ধরা পড়ে যতটা ছোটো মনে হচ্ছিল, তার থেকে অনেক বড়ো সমস্যা তৈরি হয়েছে কলম্বিয়াতে! পৃথিবী থেকে অনেক অনেক দূরে থাকা সেই মহাকাশচারীরা নিজেদের অসহায় মনে করেছিলেন কি? কল্পনা কি ভেবেছিলেন স্বপ্নপূরণ আর সম্ভব নয় কক্ষনো? ঠিক ১৫ দিনের ব্যবধান। NASA-র নির্দেশে ত্রুটিপূর্ণ কলম্বিয়াকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেওয়া হল। দিনটা ছিল ১লা ফেব্রুয়ারি, আজকেরই দিন, ২০০৩ সাল। গবেষণা প্রায় সমাপ্ত করে ফিরে আসছে কলম্বিয়া। বিজ্ঞানীরা অপেক্ষা করছেন। আর মাত্র কয়েকটা ঘণ্টা, তারপরেই আবার নতুন করে মহাকাশযানটিকে মেরামত করতে হবে। পৃথিবীর আকাশে ভেসে উঠল কলম্বিয়ার অবয়ব। যাক নিশ্চিন্ত তবে, এইবার শুধু নামার অপেক্ষা। ঠিক তারপরেই অঘটন, শেষ মুহূর্তটির জন্য যেন কেউ অপেক্ষা করেননি কখনো। বায়ুমণ্ডলের সংস্পর্শে আগুন ধরে গেল কলম্বিয়ায়। প্রচণ্ড বেগে ভস্মীভূত মহাকাশযানটি নামতে লাগল পৃথিবী পৃষ্ঠে। ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকা কল্পনার খোয়াব অধুরাই থেকে গেল, মাত্র ৩৫ বছর বয়সে। শেষমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি কি ভাবতে পেরেছিলেন মৃত্যু তার দোরগোড়ায়? কল্পনাসহ তার বাকি ছ'জন সঙ্গীও সেইদিন অনেক অনেক আলোকবর্ষ দূরে পাড়ি দিয়েছিলেন। মহাশূন্যের সীমানা তাদের আটকে রাখতে পারেনি।
কল্পনাদের মৃত্যু হয় কি? কল্পনারা মারা গেলে তো সমস্ত স্বপ্নই মারা যাবে, আর স্বপ্ন না থাকলে বাস্তবই বা থাকবে কী করে? পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন বা আইএসএস। মহাকাশচারীদের বিভিন্ন প্রয়োজনে স্পেস স্টেশন মেরামতির জন্য নানান সরঞ্জামের প্রয়োজন হয়। সেই উদ্দেশ্যেই আইএসএসকে মহাশূন্যে প্রেরণ করা হয়। কল্পনাকে ভোলেনি NASA. তাঁকে স্মরণে রেখে তাঁর নামেই রকেটটির নামকরণ করা হয়। 'এস এস কল্পনা চাওলা' নামক সেই ক্যাপসুল কার্গো মহাকাশযানটির মহাশূন্যে পাড়ি দেওয়ার কথা ছিল অক্টোবর মাসে কিন্তু শেষ মুহূর্তে কিছু 'অজ্ঞাত' সমস্যার কারণে উৎক্ষেপণ স্থগিত করে NASA. শুধু এটুকুতেই শেষ হয়ে যায়নি। একের পর এক বহু সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে তাঁকে। কখনো তাঁর নামে উৎসর্গ করা হয়েছে সুপার কম্পিউটার, কখনো বা কলরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নামে ঘোষিত হয়েছে অ্যালাম্নি অ্যাওয়ার্ড। ভারতের তরুণী বিজ্ঞানীদের কল্পনা চাওলা অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করেন কর্ণাটক সরকার ২০০৪ সালে। হরিয়ানা সরকার কুরুক্ষেত্রে তৈরি করেন কল্পনা চাওলা প্ল্যানেটোরিয়াম। অসংখ্য সম্মানে তাঁকে স্মরণ করা হয়েছে। সেই তালিকা শেষ হওয়ার নয়। আসলে কল্পনারা অন্তহীন, 'মৃত্যু' নামক ছোট্ট শব্দটি কল্পনাদের কাছে বারবার পরাজিত হয়।
বিতান দে
__________
০১.০২.২০২১
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন