প্রথমা আনন্দী
১৮৮৬ সালে পেনসিলভেনিয়া মেডিকেল কলেজে পাঠরত আন্নদীবাই যোশী
‘আমি জানি, নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে কেমন করে আপনি বিদেশে গিয়েছেন এবং অধ্যবসায়ের সঙ্গে জ্ঞানার্জন করছেন। আমাদের দেশে আধুনিক যুগে আপনি এক মহান নারী। জানতে পারলাম, আপনার এখন অর্থের প্রয়োজন। আমি এক পত্রিকার সম্পাদক। আয় বেশি নয়। তবু আপনাকে ১০০ টাকা পাঠাতে চাই।’
চিঠিটি লিখছেন ‘কেশরী’ পত্রিকার সম্পাদক বাল গঙ্গাধর তিলক, আর যাকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছে এই চিঠি তাঁর নাম আনন্দীবাই জোশি। ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার তিনি। বিয়ের আগে তাঁর নাম ছিল যমুনা। ১৮৬৫ সালে মহারাষ্ট্রের ঠানে জেলার কল্যাণে তাঁর জন্ম। মাত্র ন’বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় ডাক বিভাগের কর্মী, বছর ঊনত্রিশের গোপাল রাওয়ের সঙ্গে। তিনিই যমুনার নাম দিয়েছিলেন ‘আনন্দী’। তৎকালীন সময়ের নিরিখে আনন্দীর বিয়ে কিছুটা হলেও দেরিতেই হয়েছিল। আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য, মেয়ে হলেও আনন্দী অল্পস্বল্প মরাঠি পড়তে পারতেন, অক্ষর জ্ঞান তাঁর ছিল। সেই সময়ের নিরিখে যা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ; কেননা তখন বাংলার বুকে নবজাগরণের ঢেউয়ে স্ত্রী শিক্ষার যৎসামান্য প্রসার ঘটলেও, সর্বভারতীয় স্তরে, বিশেষ করে পশ্চিম বা উত্তর ভারতের স্ত্রীশিক্ষার ছবিটা তেমন উজ্জ্বল ছিল না।
বিয়ের পর পাঁচ বছরের মাথায় নিজের চোদ্দো বছর বয়সে আনন্দী মা হলেন। এরপরের কাহিনিটি একদিকে যেমন ট্র্যাজিক ঠিক তেমনই সেই কাহিনির মধ্য থেকে উঠে আসে ভারতীয় মানবী ইতিহাসের এক স্বর্ণোজ্জ্বল লড়াইয়ের ইতিহাস, সংগ্রামের ইতিহাস। যে ইতিহাস আনন্দীকে প্রতিষ্ঠিত করে ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার হিসেবে। মা থেকে ডাক্তার হয়ে ওঠার তাঁর এই কাহিনি হয়তো অনেকেরই অজানা, অনেকে হয়ত আনন্দীর নামও শোনেননি। বাংলার প্রথম মহিলা ডাক্তার হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় হালের টিভি সিরিয়ালের দৌলতে বাঙালির কাছে যতটা পরিচিত, সর্বভারতীয় স্তরেও কাদম্বিনীর সেই পরিচয় রয়েছে, কাদম্বিনীকে নিয়ে গবেষণা, অনুসন্ধানের নজির কিছু হলেও সুলভ, কিন্তু আনন্দীবাই যোশী কার্যত বিস্মৃত একটি নাম।
সাল ১৮৮৬। আমেরিকার পেনসিলভেনিয়ার উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজের গ্র্যাজুয়েশন সেরিমনিতে তোলা হচ্ছে এই ছবিটি। ছবিতে বাঁদিক থেকে রয়েছে আনন্দীবাই, জাপানের কেই অকামি এবং সিরিয়ার তাবাত এম ইসলামবুলি। ছবির তিন জনই তাঁদের দেশ থেকে পশ্চিমে ডাক্তারি পড়তে আসা প্রথম মহিলা।
সাল ১৮৮৬। আমেরিকার পেনসিলভেনিয়ার উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজের গ্র্যাজুয়েশন সেরিমনিতে তোলা হচ্ছে একটি ঐতিহাসিক ছবি, ছবিতে রয়েছেন তিন মহিলা— জাপানের কেই অকামি, সিরিয়ার তাবাত এম ইসলামবুলি এবং ভারতের আনন্দীবাই জোশী। ছবির তিন জনই তাঁদের দেশ থেকে পশ্চিমে ডাক্তারি পড়তে আসা প্রথম মহিলা। কিন্তু মহারাষ্ট্রের কল্যাণ থেকে আমেরিকার পেনসিলভেনিয়ার এই যাত্রাপথ উনিশ শতকের পরাধীন ভারতবর্ষের এক মহিলার পক্ষে মোটেই সহজসাধ্য ছিল না, পদে পদে ছিল সমাজ ও পরিবারের বাধা, সংস্কার আর রক্ষণশীলতার শৃঙ্খল। যদিও আনন্দীবাই তাঁর লড়াইয়ের পথে পরিবারের সহযোগিতা পেয়েছিলেন বলেই জানা যায়। কিন্তু তাঁর জীবনের গভীর অনুসন্ধিৎসু গবেষণা সাম্প্রতিক সময়ে প্রমাণ করেছে যে পরিবারের অভ্যন্তরেও তাঁকে লড়তে হয়েছিল প্রতি পদে। সেই প্রসঙ্গে আমরা পরে আসছি। তাঁর আগে দেখা যাক কেমন ছিল যমুনা ওরফে আনন্দীর ছেলেবেলা। আগেই বলেছি ১৮৬৫ সালে তাঁর জন্ম, তারিখ ৩১ মার্চ। তাঁর বাবা গণপতরাও জোশী ও মা গঙ্গাবাই ছিলেন স্ত্রীশিক্ষায় উৎসাহী, তাই অল্প বয়সেই মরাঠি পড়তে শেখেন আনন্দীবাই ও তাঁর অন্য বোনেরা— বাড়িতে আলাদা করে মেয়েদের জন্য খোলা হয়েছিল একটি স্কুল। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় আনন্দীর জীবন নিয়ে এই প্রচলিত মিথ কার্যত ভেঙে যায়। মীরা কোসাম্বির লেখা বই ‘আ ফ্র্যাগমেন্টেড ফেমিনিজ়ম: দ্য লাইফ অ্যান্ড লেটার্স অব আনন্দীবাই জোশী’ বইটি সম্পূর্ণ নতুন আলোকে তুলে ধরে তাঁর জীবনকে, এতে রয়েছে আনন্দীবাই জোশীর জীবনের এক ভিন্ন আঙ্গিক এবং প্রকাশ্যে না আসা তাঁর বেশ কিছু মূল্যবান চিঠিপত্র, যেগুলি বহন করে তাঁর ও গোপালরাও-এর দাম্পত্যের মধ্যেকার টানাপড়েন, ব্যক্ত করে আধুনিকতা এবং ঐতিহ্যের চিরকালীন দোলাচলে ভোগা আনন্দীর ভিতরকার দ্বন্দ্ব। যা এত দিন অপ্রকাশ্যই থেকে গিয়েছিল। বইটি থেকে জানা যায় গণপতরাও জোশী এবং গঙ্গাবাইয়ের পঞ্চম সন্তান ছিলেন আনন্দীবাই। মোট ন’জন ভাইবোনের মধ্যে তাঁরা বেঁচে ছিলেন মাত্র চার জন। আনন্দী তাঁদেরই এক জন। মুম্বইয়ের শহরতলি, তৎকালীন গ্রাম কল্যাণে বিস্তর জমিজমা ছিল এই জোশী পরিবারের। সময়ের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে গিয়েও পরিবারটি মোটের উপর সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিতই ছিল। মীরা কোসাম্বির বই থেকে জানা যায়, আনন্দীর শৈশব মোটেই উদার-মানবিক ছিল না; বরং ছিল ত্রস্ত, তাঁর মায়ের অত্যধিক কড়া শাসনের ভারে বিধ্বস্ত। মীরা তাঁর বইয়ের মুখবন্ধে এর ব্যাখ্যা দিয়ে লিখেছেন:
‘তখনকার দিনে এই ধরনের পরিবারে এমন শাসন ছিল জলভাত। কারণ এই পরিবারগুলি শৈশবেই শিশুকন্যার মন থেকে যাবতীয় মুক্ত চিন্তা, স্বাধীন বিচারের শেষ দাগটুকুও মিলিয়ে দিতে ছিল তৎপর। যাতে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে শাশুড়ির গঞ্জনা সহ্য করতে না হয়।’
কিন্তু কেমন ছিল সেই শাসন পীড়ন? আমেরিকার এক বন্ধুকে লেখা আনন্দীর চিঠি এ প্রসঙ্গে উদ্ধ্বত করেছেন মীরা। চিঠিতে আনন্দী লিখছেন:
‘মা কখনও আদর করে কথা বলেনি আমার সঙ্গে। যখন শাস্তি দিত তখন ছোটখাটো কিছু দিয়ে নয়, গরম কয়লা, ঢিল অথবা লাঠি পড়ত পিঠে। ভাগ্যবশত আমার শরীরের যা গড়ন তাতে দাগ ধরত না। তাই এই প্রহারের কোনও চিহ্ন চিরস্থায়ী ভাবে থেকে যায়নি।’
তুলনামূলক ভাবে তাঁর পিতা ছিলেন কিছুটা স্নেহশীল। ছোটবেলায় আনন্দী সামান্য যেটুকু লেখাপড়া শিখতে পেরেছিলেন; তাঁর বাবাই ছিলেন সেটুকুর উদ্যোক্তা।
আনন্দীবাই এর পিতা গণপতরাও যোশী
এরপর প্রচলিত ইতিহাস হল, সাংসারিক অনটনের ফলে আনন্দীবাই-এর বিয়ে হয়ে যায় ডাকবিভাগের ক্লার্ক, বিপত্নীক গোপালরাও জোশীর সঙ্গে। জানা যায় স্ত্রীকে উচ্চশিক্ষিত করবেন, এই শর্তেই ৯ বছরের আনন্দীকে বিয়ে করতে রাজি হন ২৯ বছরের গোপালরাও। কিন্তু মীরা তাঁর বইয়ে আমাদের জানাচ্ছেন অন্য কথা। স্নেহশীল পিতা হয়েও গণপতরাও মাত্র ন’বছর বয়সে তার চেয়ে সতেরো মতান্তরে কুড়ি বছরের বড় এক ব্যক্তির (গোপালরাও জোশী) সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেন মেয়ে আনন্দীর।
বছর ছাব্বিশের মতান্তরে ঊনত্রিশের পোস্টম্যান গোপালরাও সে সময় মহারাষ্ট্রের উচ্চবর্ণের মানুষের সংস্কার আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন, কিন্তু তিনি ইংরেজি জানতেন না বলে তাঁকে নিয়ে লোকে ঠাট্টা-মস্করা করত। এটা ঠিক যে বাল্যবিবাহে গোপালরাও এই শর্তেই রাজি হয়েছিলেন যে, বিবাহের পর স্ত্রীকে তিনি পড়াবেন। আনন্দীর বাবা-মাও তাতে মত দেন। গোপালরাও নিজের সামাজিক অপমানের জ্বালা ভুলতেই এই শিশু কন্যাটিকে পড়াশোনা করাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। অর্থাৎ প্রগতিশীলতার পিছনে সক্রিয় ছিল ব্যক্তি স্বার্থ। যতটা না ভালোবেসে নিজের স্ত্রীকে পড়ানোর ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন তার চেয়েও বেশি ক্রিয়াশীল ছিল উচ্চবর্গের কাছে সামাজিক সম্মান এবং আর্থিক নিরাপত্তার লোভ— মীরার বইটি এই দিকটিকেই তুলে ধরে তথ্যপ্রমাণসহ।
মীরা আরও লিখছেন যে আনন্দীবাই-গোপালরাওয়ের দাম্পত্যজীবন ছিল জটিলতায় ভরা। কিন্তু কীসের ভিত্তিতে তিনি বলছেন একথা, বরং সর্বসাধারণের কাছে তো স্ত্রীকে ডাক্তারি পড়তে সমর্থন ও উৎসাহ জোগানো এক আদর্শবান স্বামী, প্রগতিশীল পুরুষ হিসেবেই গোপালরাও এর পরিচিতি, তবে? কেন বলছেন মীরা এ কথা?
আনন্দীবাই-এর স্বামী গোপালরাও যোশী
আনন্দীবাই আমেরিকায় থাকার সময় (১৮৮৫ নাগাদ) স্বামীকে বেশ কিছু চিঠি লিখেছিলেন। দুষ্প্রাপ্য সেই চিঠিগুলি সংগ্রহ করে তাঁর বইয়ে স্থান দিয়েছেন মীরা। সেরকমই একটি চিঠিতে আনন্দী স্বামীকে উদ্দেশ্য করে লিখছেন:
‘আমার প্রতি আপনার ব্যবহার ভাল ছিল না মন্দ, এটা নির্ণয় করা খুবই কঠিন। আমায় যদি প্রশ্ন করেন, আমি বলব দু’টোই। আপনার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে হয়তো এটাই ঠিক ছিল। কিন্তু সব দিক বিচার করে বলতেই হবে আপনি ঠিক করেননি। আপনার অত্যাচার একটা বাচ্চার মনে কী প্রভাব ফেলতে পারে সেটা ভাবেননি। ভাঙা কাঠের টুকরো দিয়ে আমাকে আঘাত করেছেন, চেয়ার বইপত্র আমার দিকে ছুড়ে মেরেছেন, তখন আমার দশ বছর বয়স মাত্র। আমাকে ছেড়ে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন যখন আমি বারো। আরও কত না নতুন রকম শাস্তি দেওয়ার ভয় দেখিয়েছেন, তখন আমি চোদ্দো। এই প্রতিটি বয়সে ধাপে ধাপে শরীর এবং মনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গিয়েছে আমার।’
আনন্দী আরও লিখছেন,
‘এক জন হিন্দু নারীর কোনও অধিকার নেই তাঁর স্বামীর সামনে একটি কথাও বলার। অন্য দিকে স্বামী যা ইচ্ছে করে চললে, মুখ বুজে বসে থাকাটাই বিধান। প্রত্যেক হিন্দু স্বামীর উচিত তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে ধৈর্যশীলতার প্রশিক্ষণ নেওয়া। আমি অবশ্য এটাও বিশ্বাস করি যে আপনি না থাকলে আজ যে জায়গায় পৌঁছেছি সেখানে হয়তো পৌঁছতে পারতাম না। সে জন্য আমি চিরকাল কৃতজ্ঞও থাকব। তবে আপনিও অস্বীকার করতে পারবেন না যে আপনার অত্যাচারের, ক্রোধের মুখে আমি সব সময়ই শান্ত থেকেছি।’
এই চিঠির উদ্ধৃতির পর আশা করা যায় পাঠক বুঝতেই পারছেন আনন্দীর ‘ডাক্তার আনন্দী’ হয়ে ওঠার পিছনে গোপালরাও-এর অবদান থাকলেও গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হওয়া এক নারীর মানসিক ও শারীরিক লড়াই কত তীব্র, কত কঠিন হলে তবে গিয়ে নিজের সংকল্পকে বাস্তবায়িত করা যায়। বিবাহিত জীবনের একত্রযাপন পর্বে আনন্দীর ‘শান্ত’ থাকার মধ্যে এক ধরনের মেনে নেওয়ার মনোভঙ্গী কাজ করলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আনন্দীবাই হয়ে উঠেছেন এক আত্মপ্রত্যয়ী নারী। আমেরিকার পর্বে স্বামীকে লেখা তাঁর চিঠিগুলিতেই সে কথা স্পষ্ট। কিন্তু শেষপর্যন্ত তাঁর মধ্যে একটা সামাজিক সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব সর্বদাই কাজ করে গিয়েছে। স্বামীকে চিঠিতে তাঁর উপর করা অত্যাচারের কথা মনে করিয়ে দিয়েও প্রকাশ্যে বা সরাসরি কোনো তিরস্কার করেননি। নিজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও গোপালরাওকে ছেড়ে যাননি। আসলে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নির্মিত প্রবণতা এবং যে পারিবারিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে তিনি উঠে এসেছেন তার প্রকাশ্য বিরোধিতা তিনি কখনই করেননি। এমনকি বাল্যবিবাহের মতো কুপ্রথাকেও আমেরিকার বন্ধুদের কাছে ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে নায্য বলে দাবি করেছেন।
আর এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে মীরা কোসাম্বির বইয়ের শিরোনামস্থ ‘ফ্র্যাগমেন্টেড ফেমিনিজম’ শব্দবন্ধটি। যার মধ্য দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন কীভাবে নারী আন্দোলনের ইতিহাসের অংশ হয়েও আনন্দীর অস্তিত্বের পড়তে বিদ্যমান থাকে একটি টানাপড়েন। এক দিকে প্রগতিশীল মনন, অন্য দিকে ঐতিহ্যকে প্রত্যক্ষভাবে অস্বীকার না-করতে পারার সামাজিক বাধ্যবাধকতা। এই দুইয়ের সংমিশ্রণেই আনন্দীর নারীবাদ; তাঁর সংগ্রাম।
আগেই বলেছি মীরা কোসাম্বির বইটিতে আনন্দীর জীবন প্রসঙ্গে প্রচলিত মিথগুলি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার হিসেবে আনন্দীর যে প্রতিষ্ঠা তার পিছনে তাঁর স্বামী গোপালরাও জোশীর যে অবদান— সেই অবদানের আতিশয্য এবং পুরুষনির্ভরতার নির্মাণকে তথ্যপ্রমাণ দিয়ে চ্যালেঞ্জ করেছেন মীরা কোসাম্বি। এর ফলে আনন্দীবাই জোশীর কৃতিত্ব আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।
যাই হোক, ফিরে আসা যাক আনন্দীর জীবনের পথে, অল্পবয়সে বিয়ের পর আনন্দীবাই-এর পড়াশোনার অভ্যাসে ছেদ পড়েনি, তবে খুব একটা এগোনোও হয়নি; উপরন্তু মাত্র ১৪ বছর বয়সে এক পুত্রসন্তানের মা হন তিনি। কিন্তু দশ দিনের মধ্যে বিনা চিকিৎসায় মারা যায় সেই সন্তান।
বিনা চিকিৎসায় সন্তান হারানোর শোক আনন্দীর মনে জন্ম দেয় এক সংকল্পের। আনন্দীবাই ঠিক করেন, তাঁকে ডাক্তার হতে হবে। উনিশ শতকের সেই প্রেক্ষাপটে মহারাষ্ট্রের একটি ছোট্ট গ্রামে যেখানে পুরুষ ডাক্তারই নেই, সেখানে মহিলা ডাক্তার? সকলে ভাবলেন পুত্রশোকে আনন্দীর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। ইংরেজি তো দূরে থাক, সংস্কৃত পর্যন্ত পড়তে পারেন না তিনি। ডাক্তার হবেন কী করে? কিন্তু আনন্দীবাই অনড়। ডাক্তার তাঁকে হতেই হবে।
আশ্চর্যের হলেও বাংলার প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনীর গঙ্গোপাধ্যায়ের মতোই ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার আনন্দীর জীবনের সঙ্গেও এরপর জুড়ে যায় বাংলার নাম। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হবেন বলেই আনন্দী তাঁর স্বামীর সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন। গোপালরাও নিজের বদলি করান বাংলাতে, স্বামী-স্ত্রী থাকতে শুরু করেন শ্রীরামপুরে।
বাংলায় থাকাকালীন ১৮৮০ সালে গোপালরাও স্ত্রীশিক্ষায় উৎসাহী মার্কিন মিশনারি রেভারেন্ড ওয়াইল্ডারকে একটি দীর্ঘ চিঠি লেখেন, চিঠিতে তিনি আনন্দীর সবিস্তার পরিচয় দিয়ে তাঁর ডাক্তার হতে চাওয়া, কলকাতায় আসা, ইংরেজি শেখা ইত্যাদি বিষয়ে জানান। চিঠিটি পড়ে রেভারেন্ড অবাক হয়ে যান। এক ভারতীয় মহিলার এতখানি উৎসাহ তাঁকে চমকে দেয়। ‘প্রিন্সটন মিশনারি রিভিউ’ নামের পত্রিকায় চিঠিটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন তিনি, ব্যক্তিগত ভাবে উত্তরও দেন। চিঠিটি পত্রিকায় প্রকাশিত হলে আমেরিকার নিউ জার্সির অধিবাসী থিয়োডিসিয়া কার্পেন্টার নামে এক মহিলা নিজ উদ্যোগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। চিঠিপত্রে এই মহিলার সঙ্গে আনন্দীর নারী স্বাধীনতা, বাল্যবিবাহের কুফল ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হত। ক্রমে দুজনের সখ্য গড়ে ওঠে, থিয়োডিসিয়া-ই চিঠিতে জানান থোরবোর্ন নামের ডাক্তার দম্পতির কথা, যাঁরা আমেরিকায় আনন্দীবাই-এর ডাক্তারি পড়ার ব্যবস্থা করতে পারেন। আরও জানান, তাঁদের চেনা দু’জন মিশনারি ভারত থেকে জাহাজে আমেরিকায় আসছেন, আনন্দীবাই চাইলে তাঁদের সঙ্গে চলে আসতে পারেন। সেইমতো ১৮৮৩ সালে, মাত্র ১৯ বছর বয়সে থিয়োডিসিয়ার চিঠির ভরসায় একজন বিবাহিত ভারতীয় মহিলা হিসেবে সম্পূর্ণ একা আমেরিকা পাড়ি দেন আনন্দী। কলকাতা থেকে জাহাজ ছাড়ে তাঁর।
থিয়োডিসিয়া কার্পেন্টার: আনন্দীর আমেরিকার বন্ধু
আমেরিকায় পৌঁছে রাসেল-এ থিয়োডিসিয়ার কাছে ওঠেন তিনি। এরপর থোরবোর্ন দম্পতির সহায়তায় পেনসিলভেনিয়ার উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারিতে ভর্তি হন এবং প্রত্যেকটি ধাপে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। ১৮৮৬ সালে সেখান থেকেই ডাক্তারি পাশ করেন তিনি।
ইতিহাসের আশ্চর্য সমাপতন এই যে, প্রায় একই সময়ে কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেন কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। দুই দেশের শিক্ষাবর্ষের পার্থক্যের কারণে দুজনের পাশ করার মধ্যে ছিল মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধান। আগে আনন্দীবাই জোশী ডাক্তারি পাশ করেন ১৮৮৬-র, ১১ মার্চ, আর কয়েক মাস পরে পাশ করেন কাদম্বিনী। বছরটা একই, ১৮৮৬।
এরপর অবশ্য আনন্দী আর কাদম্বিনীর জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ নেয়। ১৮৮৮ সালে লেডি ডাফরিন কলেজে প্র্যাকটিস শুরু করেন কাদম্বিনী, হয়ে ওঠেন ভারতের প্রথম প্র্যাক্টিসিং মহিলা ডাক্তার। ১৮৯৩ সালে কাদম্বিনী পাড়ি দেন বিদেশে, ডাক্তারির উচ্চশিক্ষার জন্য। অন্যদিকে আনন্দীবাই; যিনি চোদ্দো বছর বয়সেদশ দিন বয়সী মৃত পুত্রকে কোলে নিয়ে ঠিক করেছিলেন ডাক্তার হবেন এবং সাত বছরের মধ্যে তা বাস্তবায়িতও করলেন— কিন্তু তাঁর যাত্রাপথ ঠিক ততটা সুগম হল না।
১৮৮৭ সালে দেশে ফেরেন আনন্দীবাই। কোলাপুরের রাজা তাঁকে বিশেষ সংবর্ধনা দেন এবং সেই সঙ্গে অ্যালবার্ট এডওয়ার্ড হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডের দায়িত্ব তুলে দেন তাঁর হাতে। কিন্তু প্রবাসে থাকাকালীন প্রতিকূল আবহাওয়া ও খাদ্যাভ্যাস সহ্য হয়নি আনন্দীর। যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। ফলস্বরূপ ১৮৮৭ সালে, ২৬ ফেব্রুয়ারি, মাত্র ২১ বছর বয়সেই থেমে যায় এই ইতিহাস সৃষ্টিকারী নারীর জীবন। মারা যান আনন্দীবাই।
জীবৎকালের ব্যপ্তি স্বল্প হলেও আনন্দীবাই-এর জীবন অনুপ্রেরণাদায়ক, সর্বোপরি ঐতিহাসিক। তাঁর জীবন সম্পর্কে খুব বেশি প্রামাণ্য নথি মেলে না, তথ্য এবং ধারণার ভ্রান্তিও রয়েছে, সার্বিকভাবে প্রথম মহিলা ডাক্তার হিসেবে ভারতের নারী আন্দোলনের ইতিহাসে আনন্দীবাই-এর নাম যতটা আলোচিত হওয়া উচিত ছিল ততটা হয়নি। আনন্দীর ইতিহাসকে তাই আমাদের নতুনভাবে ফিরে পড়া উচিত, কেননা কাদম্বিনী হোক বা আনন্দীবাই বা এরকম আরও অনেক নাম— ভারতের মানবী ইতিহাসের এই সোনালি পাতাগুলিকে হারিয়ে যেতে দিলে চলবে না, আগামীর আনন্দী আগামীর কাদম্বিনীদের লড়াই-এর জন্য এই ইতিহাস আমাদের জানা এবং জানানো ভীষণ প্রয়োজন।
ছবি ও স্বাক্ষর: আনন্দীবাই
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন