অন্ধকার কখনো কখনো আলো হয়ে ঝলসে ওঠে

সুতোমু ইয়ামাগুচি মাস তিনেকের জন্য গিয়েছিলেন হিরোশিমায়। ‘গিয়েছিলেন’ মানে, তাঁর অফিস থেকে কাজের সূত্রে পাঠানো হয়েছিল তাঁকে। কাজকম্ম সেরে তিন মাস পর যেদিন তিনি বাড়ি ফিরবেন বলে তোড়জোর করছেন, সেই সকালে, ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট, আকাশ থেকে নেমে এল বজ্র! চোখের পলক না-ফেলতেই মুছে গেল আস্ত এক শহর, তৎক্ষণাৎ মারা গেলেন কমবেশি ৮০ হাজার মানুষ। 

ইয়ামাগুচি কিন্তু বেঁচে রইলেন। ঘটনাকেন্দ্র থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ছিলেন তিনি, লোহা ও কংক্রিটের কিছু আড়াল তাঁকে বাঁচিয়ে দিল। কানের পর্দা ফেটে গেল তাঁর, চোখ দুটো সাময়িক অন্ধ হয়ে গেল, শরীরের বাঁ দিকটা ঝলসে গেল বিচ্ছিরিভাবে, কিন্তু বেঁচে গেলেন!


শেষপর্যন্ত, কোনোক্রমে ওই অভিশপ্ত শহর থেকে বেরিয়ে এসে দুদিন পর তিনি ফিরে এলেন নিজের শহরে। নিজের বাড়িতে।


ওহ্‌, একটা কথা বলা হয়নি। কোনটা তাঁর নিজের শহর?


নাগাসাকি! 


৯ আগস্ট সেখানে নামল মৃত্যু। কিন্তু, কি আশ্চর্য, এবারেও নানা ঘটনা-পরম্পরায় তিনি বেঁচে গেলেন! জাপান সরকারের অফিসিয়াল-রেকর্ড মোতাবেক ইয়ামাগুচিই একমাত্র মানুষ যিনি দুটো পরমাণু-বোমার অভিঘাত সামলেও বেঁচে ছিলেন।


পরবর্তীকালে, পরমাণুবোমা-বিরোধী পৃথিবীজোড়া যেসব গণ-আন্দোলন হয়েছে ইয়ামাগুচি হয়ে উঠেছিলেন তার এক প্রধান মুখ। আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন একে অন্যকে টেক্কা দিয়ে বৃহৎ থেকে বৃহত্তর বোমা বানানোর নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায় আসর জমিয়েছিল, ইয়ামাগুচি পরম বেদনার সঙ্গে বলেছিলেন, এত বোমা এরা ফেলবে কোথায়? মরার জন্য এত মানুষ যে পৃথিবীতে নেই!


অন্ধকার থেকে, মৃত্যু থেকে, জীবনের যথার্থ পাঠ পড়তে শিখেছিলেন সুতোমু ইয়ামাগুচি!


২.


জাপানেরই অন্য একজন মানুষের গল্পও এই সুযোগে বলে ফেলি। এই মানুষটির নাম রিওজি উয়েহারা।


আপনারা জানেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রশান্ত মহাসাগর-চ্যাপ্টারে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল ওকিনাওয়া দ্বীপকে কেন্দ্র করে। সে এক মর্মান্তিক ইতিহাস। এই যুদ্ধে জাপান বিপুল সংখ্যায় আত্মঘাতী ‘কামিকাজ়ে’ বম্বারদের ব্যবহার করে। ছোট ফাইটার প্লেনে ঠেসে বারুদ পুরে সেই প্লেন-সুদ্ধ ঢুকে যেতে হবে শত্রুপক্ষের কোনো যুদ্ধজাহাজের পেটের ভিতরে! 


১৯৪৫ সালের ১১ মে ২২ বছর বয়সী উয়েহারা যাবেন সেই ‘মিশনে’, জীবনের শেষ কাজে, রাষ্ট্রের ডাক এসেছে। তার আগের রাত্রে, এই তরুণ একটা চিঠি লেখেন তাঁর মা আর বাবাকে। আজি এই রজনীর তিমির ফলকে/ প্রত্যক্ষ করিনু পাঠ নক্ষত্র-আলোকে/ ঘোর যুদ্ধ-ফল।


জানো, কলেজে যখন দর্শনের বইপত্রগুলো পড়তাম, তখন থেকেই বুঝতে শিখেছিলাম, মুক্তির চেয়ে বড়ো আর কোনো আকাঙ্ক্ষা হয় না। এই যুদ্ধে এর মধ্যেই হেরে গেছে ইতালি, হেরেছে জার্মানি। হেরেছে, কেন না মানুষের স্বাধীনতা আর মুক্তির ইচ্ছাকে এরা দমন করতে চেয়েছে প্রাণপণে। ক্রোচে যেমন বলেছিলেন, মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে সাময়িকভাবে চেপে রাখা যায়, কিন্তু আদতে ও জিনিস অপরাজেয়।


লিখে চলেন উয়েহারা : আমি তাই এখন বুঝতে পারছি, জাপান এই যুদ্ধে হারবে। আমি খুশি হব যদি জাপান এই যুদ্ধে হারে। তার এই নির্মম পরাজয়ের পথ ধরেই আসলে আমার মাতৃভূমির ক্রমমুক্তি হবে।


৩.


অন্ধকার এইভাবে কখনও-কখনও আলো-হয়ে ঝলসে ওঠে। সামনে-দাঁড়ানো মৃত্যু দিয়ে যায় জীবনেরই চূড়ান্ত শিক্ষা। নাস্তি এসে হাত ধরে অস্তির।

 

উপরের ‘কাহিনি’গুলোর সঙ্গে কিছুমাত্র তুলনীয় নয়, তবু, কাল রাত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-সম্পর্কিত একটা বই পড়তে পড়তে আমি ভাবছিলাম আমাদের এই সময়টার কথা : 

এই যে চারপাশে একটা গা-ছমছমে ভয় ক্রমশ আমাদের গ্রাস করছে, এই যে চোখের-সামনে তছনছ হয়ে যাচ্ছে স্বাভাবিক যাপনপ্রণালী, এ কি আমাদের কিছু শিখিয়ে যাচ্ছে তিলে তিলে? সমস্ত অর্থ-ক্ষমতা-প্রতিপত্তি দিয়েও যখন ঠেকাতে পারছি না একধরনের নাছোড় উৎকণ্ঠা, অনিবার্য অসহায়ত্বের বোধ, তখন তা আমাদের ভিতরে সঙিন-উঁচিয়ে-জেগে-থাকা অহং-কে তার অওকাদ খানিক বুঝিয়ে দিতে পারছে কি?


ভাবতে ইচ্ছে করে, এইটুকু আলো হয়তো জ্বলে উঠছে কোথাও। ধীরে ধীরে, অল্পে অল্পে, সংগোপনে। 

 

দেখা যাক।



_____________________


জয়দীপ ঘোষ, ইছাপুর

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চোদ্দ ভূতের আসরে

বুদ্ধের পুতাস্থি: রাখা রয়েছে কলকাতাতেই

পার্টিশনের জীবনভাষ্য: প্রজন্মান্তরের খোঁজ