শেষের সেইদিন
১৩৪৮ বঙ্গাব্দ। ১৪২৭ বঙ্গাব্দের এক ২২শে শ্রাবণে দাঁড়িয়ে শেষের সেই দিনের দিকে যদি একবার ফিরে তাকানো হয়? এরকমই আর এক ২২শে শ্রাবণ, চলে গিয়েছিলেন পৃথিবী ছেড়ে, রবীন্দ্রনাথ। মৃত্যুকে নিজের জীবনে বারবার প্রত্যক্ষ করে শেষপর্যন্ত মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয় তাঁকেও। কেমন ছিল শেষের সেদিন, দেখা যাক।
পূর্ণিমার অবসানে তখন পুবের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। তারপর আসে সকাল। অমিয়া ঠাকুর কিছু চাঁপাফুল হাতে করে নিয়ে এসে ছড়িয়ে দেন কবির সাদা শালে ঢাকা পা দুটির উপর। সাতটায় আসেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। খাটের পাশে দাঁড়িয়ে উপাসনা করেন, আর পায়ের কাছে বিধুশেখর শাস্ত্রী মন্ত্র পড়তে থাকেন–ও৺ পিতা নো হসি, পিতা নো বোধি, নমস্তেহস্তু মা মা হিংসী–
অমিতা ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের মুখে জল দেন। প্রথমে চামচে করে, তারপর তুলো ভিজিয়ে। শরীর মাঝেমধ্যেই কেঁপে উঠতে থাকে তাঁর। বেঁকেও যায় খানিক। ডাঃ জ্যোতিষচন্দ্র রায় নাড়ি পরীক্ষা করতে থাকেন। অমিতা ঠাকুরের বয়ান থেকে জানা যায়, প্রতিমা দেবী রবীন্দ্রনাথের মন্ত্রণা তাঁর কাছে (অমিতা ঠাকুর) জানতে চান। তিনি প্রতিমা ঠাকুরকে জানান সেই মন্ত্রণা–শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্।
![]() |
শেষবারের মতো উপাসনা সেরে বেরোচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ |
চিনা অধ্যাপক তান য়ুন শান আসেন এরপর। তিনি রবীন্দ্রনাথের পাশে বসে মালা জপতে থাকেন। আসেন হেমন্তবালা দেবী, একরকম সন্ন্যাসিনীর বেশে। গুরুদেবের মাথায়-কপালে তুলসীর মালা এবং গঙ্গামাটি ছুঁইয়ে চলে যান। ডাঃ অমিয় সেন নাড়ি দেখেন। হাত ছুঁয়ে কব্জিতে নাড়ি পান না। ক্ষীণ নাড়ি পান কনুইয়ের কাছে। ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে এবং ক্ষতাবরক সংস্থান করে বেরিয়ে যান। চিকিৎসকরা পরাজিত। পৃথিবী ও ভারতের চিকিৎসকদের কাছে এই পরাজয় হয়তো সহজে মেনে নেওয়া সম্ভবপর ছিল না।
মন্ত্রপাঠ চলতে থাকে–নমঃ শংকরায়, চ, নমস্কারায় চ, নমঃ শিবায় চ, শিবতরায় চ। বেলা ৯টায় শুরু হয় অক্সিজেন দেওয়া। নিঃশ্বাসের ক্ষীণ শব্দ। নাড়ির গতি পর্যায়ক্রমে সকাল ৬টা ১৫ মিনিটে ১৪০, শ্বাস ৪৬; সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে ১৩০, শ্বাস ৪৪; সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে ৭৮, শ্বাস ৪৪। তারপর কোরামিন ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়।
মন্ত্রপাঠ চলতে থাকে–নমঃ শিবায় চ, শিবতরায় চ। রবীন্দ্রনাথের কানের কাছে আস্তে আস্তে ধ্বনিত হতে থাকে–শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্। একবার নয়, ধ্বনিত হতে থাকে বারবার। নাড়ি পাওয়া যায় না আর কিন্তু হৃদস্পন্দন চলতে থাকে ক্ষীণ গতিতে। পায়ের উষ্ণতা ক্রমশ কমতে থাকে। বাইরের বারান্দা থেকে ধীরে ধীরে ভেসে আসে গান–কে যায় অমৃতধাম যাত্রী, সঙ্গে উচ্চারিত হয় মন্ত্র, শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্।
দুপুর ১২টা, পা আরো ঠাণ্ডা হতে থাকে। হৃদস্পন্দন কমতে থাকে আরো, আরো। জনতার ভিড়ে ভরে ওঠে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। কোলাহল চারিদিকে, গান চলে, সঙ্গে মন্ত্র–শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্। ১২টা ১০ মিনিট। স্তব্ধতা আসে, চিরকালীন স্তব্ধতা। মৃত্যু কার্যত পরাস্ত করে তাঁকেও। পৃথিবীর ইতিহাসে, বাংলার ইতিহাসের সেই ২২শে শ্রাবণ, স্মরণীয় এক দিন।
বাঙালির খুব বেশি ক্ষতি করতে বোধহয় পারেননি কবি। ১৩৪৮-এর ২২শে শ্রাবণ তাই ইতিহাস সৃষ্টি করলেও যে ধারাকে বয়ে নিয়ে এসেছিল তা রবীন্দ্র উৎসবকেই প্রাধান্য দিয়েছে, তবু মনে রেখো-র স্রষ্টাকে আমরা মনে রেখেছি কিন্তু চর্চা ও চর্যায় বিচ্যুত হয়েছি ক্রমশ।
২২শে শ্রাবণ। জোড়াসাঁকোর এক উৎসবের দিনও বটে। অবনীন্দ্রনাথের সত্তরতম জন্মদিন, অথচ সেই বাইশ সমস্তটুকুকে ম্লান করে দেয়! ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ কাকাকে অন্তিম শয্যায় দেখতে থাকেন। শিল্পীর মৃত্যু হয় না কখনো। অবন ঠাকুরের তুলি তাই মৃত্যুপথযাত্রী রবীন্দ্রনাথকে তখনই অমর করে দেয় হয়তো! ২২শে শ্রাবণ কেবল মৃত্যু নয়। শেষের সেইদিন এক পুনর্জন্ম। অবনীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের গানকে খুঁজে পেয়েছিলেন, বুঝতে পেরেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের সমস্ত জীবন ধরা আছে তাঁর গানের কথায়-সুরে; নির্দ্বিধায় জানাতে পেরেছিলেন, শিল্প থেকে শিল্পীর ব্যক্তিজীবনে পৌঁছনোর পথ সহজ নয় কিন্তু সেই পথ কেউ কেউ খুঁজে পান। শেষের সেদিন তাই সূচনা করে এক সময়ের; ২২শে শ্রাবণ এক মৃত্যু আর এক জন্মকে স্মরণীয় করে রাখে, করে তোলে জীবন্ত। ধন্য রবীন্দ্রনাথ, ধন্য অবন ঠাকুর।
![]() |
অবনীন্দ্রনাথের আঁকা রবীন্দ্রনাথের অন্তিম শয্যার ছবি |
প্রণাম, শান্তি
অমিতা ঠাকুর: অমিতা ঠাকুরের জন্ম ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১২ই ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের (অধুনা বাংলাদেশের) ফরিদপুরের মঠবাড়িতে। পিতা ছিলেন রবীন্দ্রকাব্য সমালোচক অজিত কুমার চক্রবর্তী। রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র অজীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর ষোলো বছর বয়সে বিবাহ হয়। সেই সূত্রে অমিতা হলেন রবীন্দ্রনাথের নাতবৌ। এই বিবাহেই রবীন্দ্রনাথ গান লেখেন– ‘‘এসো আমার ঘরে এসো’’, ‘‘অনন্তের বাণী তুমি’’। অমিতা অপূর্ব সুন্দরী ও সুগায়িকা ছিলেন। তাঁর সঙ্গীত শিক্ষা রবীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে।
অমিয়া ঠাকুর: অমিয়া ঠাকুর (ইংরেজি: Amiya Tagore) (জন্ম: ১৯০১; মৃত্যু: ১৯৮৮) একজন বাঙালি সঙ্গীত শিল্পী। অমিয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সরাসরি সংস্পর্শে রবীন্দ্র সঙ্গীত শেখাদের একজন। তিনি রবীন্দ্রনাথের মায়ার খেলা নৃত্য-নাট্যে পদ্মের ভূমিকায় কাজ করেন। পরবর্তীতে তিনি রবীন্দ্রনাথের বড়ো ভাইয়ের নাতিকে বিয়ে করে ঠাকুর পরিবারের একজন সদস্যে পরিণত হন। বিয়ের পর অমিয়া ঠাকুর মূলত রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন বা বিশেষ দিবসে শুধুমাত্র জনসম্মুখে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। তিনি সত্যজিৎ রায়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা চলচ্চিত্রে জন্য এ পরবাসে রবে কে হায় গানটি গেয়েছিলেন।
হেমন্তবালা দেবী: অধুনা বাংলাদেশের মৈমনসিংহের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বড়ো মেয়ে। তিনি ছিলেন অভিজাত হিন্দু রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারের অন্তঃপুরিকা। ১৯০৫-এ মাত্র ১০ বছর পরে বিবাহের পর তিনি শ্বশুরবাড়ি চলে আসেন। ১৯১৪-১৫ সাল নাগাদ স্বামীর কাছ থেকে সরিয়ে তাঁকে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত করা হয়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ১৯৩১ সাল থেকে হেমন্তবালার পত্রালাপ শুরু হয়, সেই পরিচিতি কবির অন্তিম যাত্রা পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
_________________
ঋণ: সুশোভনদার অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংক্রান্ত একটি লেখা থেকে আমি মূল্যবান কিছু তথ্য পেয়েছি।
_________________
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১| চৌধুরী, অমিতাভ। সূর্যাস্তের আগে রবীন্দ্রনাথ। দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা–৭৩। চতুর্থ সংস্করণ, আগস্ট ২০১২।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন