কিঞ্চিৎ রামকথা
ছোটোবেলায় বেশ মজা করে রামায়ণ গান শুনতে বসতাম। পাড়ার যে কোনো বাড়ির আঙিনায় হতো গান। মূল গায়েন প্রায় রামের মতোই সাজতেন, কিন্তু অভিনয় করতেন সব চরিত্রেই। গান, নাচ, অভিনয়, কথকতা মিলে বাংলার দ্বৈত-অদ্বৈতবাদী শিল্পের চমৎকার উদাহরণ এই রামায়ণ গান। মনে আছে ‘লবকুশ’ পালায় লব ও কুশ জিজ্ঞেস করছে রামচন্দ্রকে,
‘‘বলো বলো, ওহে তুমি কোন রাম?
আত্মায় আছে আত্মারাম
বিষ্ণু নাকি প্রভুরাম!
ঘরের লক্ষ্মী বনে দিল
অযোধ্যার আর এক রাম।’’
সত্যিকথাটা হলো এই অজস্র রামের অস্তিত্ব সন্ধান করতে গিয়ে আমার ‘আত্মারাম’ মাঝে মাঝেই খাঁচাছাড়া হয়ে যেত।
ইদানিং সেকালের রাষ্ট্রনীতির নায়কের আধুনিক রাজনৈতিক আঙিনায় নব-অবতার লক্ষ্য করা যাচ্ছে এবং পুরোটাই বিকৃতরূপে। এই বিকৃতির শুরু অবশ্য আজকের নয়। বহুকাল আগে থেকেই। যার ফলে মহাকবি বাল্মীকি রচিত ‘পৌলস্ত্যবধ’ পরে ‘রামায়ণ’ নামে পরিচিত পৃথিবীর সেরা চার মহাকাব্যের অন্যতম ‘মহাকাব্য’-টি কলঙ্কিত হচ্ছে। আড়ালে চলে যাচ্ছে এই কাব্যের মহত্ব। মজাটা এই, এক ব্রাহ্মণ্যবাদীরা যে বিকৃতি ঘটিয়েছিল আত্মস্বার্থে, ‘নব-ব্রাহ্মণ্যবাদী’ বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী সেই বিকৃতির অসারতা প্রমাণ না করে, বিকৃতির দোষ স্রষ্টার উপর চাপিয়ে মূল রচনাকে আক্রমণ করতেই পছন্দ করেছে বেশি। আমার এমন ধৃষ্টতা নেই, একথা বলতে পারি যে তাঁরা বাল্মীকি রচিত মূল কাব্যটি পড়েননি। তাহলে কি ইচ্ছাকৃত এই আঘাত? বলা দরকার অজ্ঞতাপ্রসূত বা ইচ্ছাকৃত যাই হোক মহাকবির রচনা যে তাতে কোনোভাবেই ছোটো হবে না, সম্ভবত এটা তাঁরা বোঝেন না।
‘Indian Wisdom’ নামের একটি গ্রন্থে বলা হয়েছে,
‘‘Notwithstanding the wilderness of exaggeration and hyperbole through which the reader of the Indian Epics has occasionally to wander, there are in the hole range of the world‘s literature few more charming poems the ‘Ramayana‘. The classical purity, clearness and simplicity of its style, the excuisite touches of true poetic feeling with which it abounds, its graphic description of heroic incidents and nature‘s grandest scenes, the deep acquaintance it displays with the conflicting working and most emotions of the human heart, all entitle if to rank among the most beautiful compositions that have appeared at any period or any country.’’
এত বড়ো একটা উদ্ধৃতি উল্লেখ করার কারণ একটাই মহাকাব্য হিসাবে ‘রামায়ণ কাব্য’-র মহত্ত্ব সর্বদেশ-জনস্বীকৃত এটা জানাবার জন্য নয়। বরং এই উদ্ধৃতির প্রতিটি শব্দ একটি মহাকাব্যের বিশিষ্টতাকে চিহ্নিত করছে, এটা আমাদের অনুসন্ধান-প্রয়াসের দিকনির্দেশনা হতে পারে ভেবেই।
যদিও ‘রামায়ণ’-এর মহাকাব্যত্ব আমার আলোচ্য বিষয় নয়, আমি শুধু দেখাতে চাই ‘রামায়ণ’ শাস্ত্র নয় মহাকাব্য এবং তা ভারত ইতিহাসের একটি বিশেষ পর্বের সাক্ষ্য বটে। রামচন্দ্র আর যাই হোন অবতার নন, তিনি মহাকাব্যের নায়ক। মহাকাব্যের মহৎ চরিত্র মহৎ শ্রোতার জন্য তৈরি হয়েছিল। যদি আমরা বাল্মীকি রচিত টেক্সট অনুসরণ করি তাহলেই অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে এ বিষয়ে এবং ‘রামায়ণ’ ও রাম চরিত্র সম্পর্কে পরবর্তী সময়ের বিকৃতির পরিবর্তে অন্য কোনো আদর্শসন্ধানে অগ্রণী হওয়া যায় কি না সেটাও ভাবা যেতে পারে।
অতএব এক এক করে এগনো যাক।
এক. ‘রামায়ণ’ কি শাস্ত্র? : ইতিহাস কী বলে?
শাস্ত্র কাকে বলে? প্রশ্নের উত্তর খুব জটিল নয়। আমি সে ব্যাখ্যায় গিয়ে মূল আলোচনা থেকে দূরে যেতে চাই না। আপাতত। ‘রামায়ণ’-এর মধ্যে তাকে শাস্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করার মতো নানা শ্লোকের উপস্থিতি সত্ত্বেও প্রামাণ্য শাস্ত্র হিসেবে সে ইতিহাসে মর্যাদা পায়নি। ধারাধিপতি ভোজরাজ প্রামাণ্য শাস্ত্রগ্রন্থের যে তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন, তাতে ‘রামায়ণ’ ঠাঁই পায়নি। স্মার্তশিরোমণি রঘুনন্দন ভট্টাচার্য ‘রামায়ণ’-কে প্রামাণ্য শাস্ত্রগ্রন্থের মর্যাদা দিতে চেয়েছেন। যেহেতু ধারাধিপতি ভোজরাজের তালিকায় সঙ্গত কারণেই ‘রামায়ণ’ শাস্ত্র হিসেবে ঠাঁই পায়নি, সেহেতু রামায়ণের মধ্যে শাস্ত্রমর্যাদাসূচক শ্লোকগুলো প্রক্ষিপ্তভাবে পরিকল্পনা করেই ঢোকানো হয়েছে-এমন সিদ্ধান্তে আমার অন্তত দ্বিমত নেই।
দুই. মহাকাব্যটির আসল নাম কী?
রামায়ণের আদিকান্ডের প্রথম চারটি সর্গে গ্রন্থরচনার পরিচয় পাওয়া যায়। সেখানে উল্লেখ রয়েছে মহাকাব্যটির বিষয় কী এবং তার নামই বা কী বলা হয়েছে?
এই শ্লোকটিতে বলা হয়েছে,
‘‘কাব্যং রামায়ণং কৃস্নং সীতায়াশ্চরিত্রং মহৎ।
পৌলস্ত্যবধ ইত্যেবং চকার চরিত্রব্রতঃ।।’’
১/৪/৭
এ থেকে বোঝা যায় ‘রামায়ণ’ প্রাথমিকভাবে পৌলস্ত্যবধ নামে পরিচিত ছিল। মনে রাখা দরকার পাণিনি তাঁর সূত্রে লৌকিকসাহিত্যের নামকরণ সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তাতে স্পষ্ট হয়, মহাকাব্যের নাম পৌলস্ত্যবধ হওয়াই সমীচীন। বিষয় হিসেবে সেখানে ‘সীতায়াশ্চরিত্রং’ ও ‘কৃস্নং রামায়ণং’ বিবৃত। ‘আধিকৃত্য কৃত্যে’ নামক গ্রন্থ অনুসারে এই শ্লোকের ‘রামায়ণ’ শব্দের অর্থ রামচরিত, কাব্যনাম হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়নি।
তাহলে তো বলাই যায়, আদিকাব্যটিকে শাস্ত্র হিসেবে প্রতিপন্ন করার জন্যই নাম পরিবর্তন। আর পরিবর্তনের হোতাদের নানা বিকৃতির তথ্যতালাশ বোধহয় খুব জরুরি। পণ্ডিতেরা সেটা না করে যখন প্রক্ষিপ্ত বিকারকে আঘাত করেন, তখন দুঃখ হয়।
তিন. রামচন্দ্র কি অবতারপুরুষ?
ক।। ব্রহ্মা-নারদ ও বাল্মীকি সংবাদ।
রামচন্দ্র কি অবতারপুরুষ? প্রশ্নটা তো লাখ টাকার। কিন্তু উত্তরটা একদম সহজ। ফলে সহজ উত্তরের সহজ ভাষ্য জানিয়ে আপনাকে আমার লেখাটি পাঠ থেকে বিরত করতে চাই না। বরং গোড়া থেকে যাই। অবশ্যই বাল্মীকি রামায়ণই আমার নির্ভরতা, টীকাকারের ব্যাখ্যা নয়। টীকাকারের ব্যাখ্যা তাঁদের জন্য, যাঁরা টেক্সটি উপেক্ষা করে গালাগালের উপাদান খোঁজা পণ্ডিত। আমি তো পণ্ডিত নই পাঠকমাত্র।
নিতান্ত সাধারণ এক পাঠক হিসেবে আমার সাধারণ সংস্কৃতজ্ঞানে ‘রামায়ণ’ পড়তে বসে দেখেছি, বাল্মীকি রামচন্দ্রের ধারণা পেয়েছেন নারদ ও ব্রহ্মার কাছ থেকে। কী বললেন ব্রহ্মা ও নারদ রাম সম্পর্কে,
বিষ্ণুনা সদৃশো বীর্য্যে সোমবৎ প্রিয়দর্শনঃ।
কালাগ্নি সদৃশঃ ক্রোধে ক্ষময়া পৃথিবীসম।।
এই শ্লোকটিতে রামচন্দ্রকে কোথাও অবতার বলা হয়নি। বীর্যে তিনি বিষ্ণুসদৃশ। ‘সদৃশ’ শব্দের অর্থ তো ‘মতো’। তাহলে রাম বিষ্ণুর মতো। বিষ্ণু নন। আবার পুরোপুরি বিষ্ণুর মতো নন, শুধুমাত্র বীর্যে বিষ্ণুর মতো। উপমা অলঙ্কার। সম্পূর্ণ আলাদা ধরণের বস্তুতে সাধারণ ধর্মের ভিত্তিতে সাম্য আরোপ হলো উপমার বৈশিষ্ট্য। এটা যদি মানি, তাহলে বলতেই হয় শ্লোকটিতে কোনোভাবেই রাম ও বিষ্ণু এক নয়। বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাসের একটি পদের কিছুটা ধার নেওয়া যাক। রাধার পূর্বরাগের বর্ণনায় কবি লিখেছেন,
‘‘বিরতি আহারে রাঙ্গাবাস পরে
যেমত যোগিনী পারা।’’
অর্থাৎ রাধা এখানে ‘যোগিনী পারা’; অর্থাৎ যোগিনীর মতো। ‘পারা’ শব্দের অর্থ তো ‘মতো’। ফলে ‘সদৃশ’ শব্দের ব্যবহারে বোঝা যায় নারদ-ভাষ্যের নরচন্দ্রমা রাম বিষ্ণুর মতো হলেও বিষ্ণু হতে পারেন না।
তাহলে প্রশ্ন শুধু তাঁকে বিষ্ণু বলা কেন? উত্তর একটাই, যেনতেন প্রকারে রামচন্দ্রকে ভগবান বানানো চাই। আর এটা বানাতে গিয়ে শ্লোকের নতুন ব্যাখ্যা হাজির হয়েছে অনেক। মুশকিলটা হলো পণ্ডিতেরা আসলটা ফেলে ‘নতুন ব্যাখ্যা’-টা নিয়েই বেশি ব্যস্ত। সেসব ব্যাখ্যারও উত্তর খুঁজব, যদি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়
আর একটা কথা বলি, পৃথিবীর চার মহাকাব্যের অন্যতম ‘রামায়ণ’, তাঁর স্রষ্টা বাল্মীকি নিশ্চয়ই কবি হিসেবে এমন দুর্বল ছিলেন না, যিনি কাব্যারাম্ভে রামচন্দ্রের দেবত্বের ঘোষণা দিয়ে মহাকাব্যের সমস্ত চমক ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে ধর্মগ্রন্থ রচনায় বসবেন। কাব্যবোধের উৎস থেকে রামায়ণ রচিত, এবং সেটা পড়তে হয় কাব্যবোধ দিয়ে। মনে হয় রামায়ণে সেটাই
‘‘all entitle if to rank among the most
beautiful compositions that have
appeared at any period or any
country.’’
তাই মহাকাব্য শুধু মহৎ কবির লেখা নয়, মহৎ পাঠকের জন্য লেখা। এটা বোধহয় আমরা মনে রাখি না।
খ।। পুত্রেষ্টি যজ্ঞ: কিছু বিভ্রান্তি
রামচন্দ্রের জন্ম প্রসঙ্গে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ বিষয়ক আলোচনাটি অদ্ভুতভাবে বিশেষ মর্যাদা পায়। গল্প হিসেবে বেশ মজারও বটে। রাজা দশরথ পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করেন পুত্র কামনায়। যজ্ঞের ঋত্বিক ঋষ্যশৃঙ্গ। যজ্ঞশেষে ঋষির নির্দেশে কৌশল্যা, কৈকেয়ী ও সুমিত্রা চরুভক্ষণ করে পুত্রবতী হন। এই চরুর গুণেই ভগবান বিষ্ণু চার অস্তিত্বে অবতীর্ণ হয়েছেন, এটাই বলা হয়েছে রামায়ণের পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ সর্গ পর্যন্ত। এই গালগল্পটি বাল্মীকির রচনা কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। গালগল্প বানাতে গেলেই তো গোলমাল বাধে। ঐ যে রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র বলেছিলেন না ‘সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর।’ এখানেও ‘বিস্তর মিছা’-র মিছিল। সে মিছিলের পলকা যুক্তিগুলো পরে বিচার করা যাবে। আপাতত দশরথের পুত্রলাভের ঘটনাটি দেখা যাক।
চতুর্দশ সর্গে বলা আছে,
তস্য চৈব প্রভাবস্য ধর্মজ্ঞস্য মহাত্মন।
সুতার্থ তপমানস্য নাসীৎ বংশকরঃ সুতঃ।।১
চিন্তয়ানস্য তস্যৈবং বুদ্ধিরাসীন্মহাত্মনঃ।
সুতার্থং বাজিমেধেন কিমর্থং ন সজ্যামহম।।২
অর্থাৎ,
এই ‘বাজিমেধ’ যজ্ঞ সমাপ্ত হলেই ঋষ্যশৃঙ্গের মুখে দশরথ শুনতে পান,
ভবিষ্যন্তি সুতা রাজংশ্চত্বারস্তে কুলোদ্বহাঃ।
১।১৪।৫৯
এবং যথারীতি দশরথ পত্নীসহ খুশিমনেই অযোধ্যায় ফিরে আসেন। ফলে পঞ্চদশ, ষোড়শ ও সপ্তদশ সর্গে বর্ণিত পুত্রেষ্টি যজ্ঞের প্রাসঙ্গিকতা কী রইল? রইল না। ওটা যে আরোপিত, সেটা প্রমাণের দায় কেন নিচ্ছেন না পণ্ডিতেরা? বরং ভুলভাল অবতারতত্ত্বটাকে গালাগাল দিয়ে মহাকবি ও তার মহৎ কাব্যটিকে ছোটো করবার প্রয়াস কিন্তু মনে রাখতে হবে এই ‘অবতারবাদ’-এর ভিত্তিতেই নয়া ‘ব্রাহ্মণ্যবাদ’ দানা বেঁধেছে। আর পুত্রেষ্টি যজ্ঞ যে একটা বড়োসড়ো ঢপ, তা প্রমাণ করা খুব কঠিন নয়। করেছেনও কেউ কেউ। সময়-সুযোগ পেলে, সে প্রসঙ্গ উত্থাপন করা যাবে না হয়।
______________________
| গৌতম অধিকারী |
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন