আকাশের পূর্ণিমা আর পৃথিবীর রাখির জন্য

কবি লিখেছিলেন,

পূর্ণচাঁদের মায়ায় আজি ভাবনা আমার পথ ভোলে।


বটেই তো! দিগন্তপ্রসারী ধু ধু-করা মাঠের সামনে কিংবা হিমালয়ের-কোলে-দাঁড়িয়ে-থাকা কোনো নির্জন গ্রামের রাত্তিরে পূর্ণচাঁদের দিকে একটিবার ভালো করে তাকিয়েছেন অথচ তার অলৌকিক মায়ায় মন খানিক পুড়ে যায়নি, এমন বোধকরি খুব বেশি কেউ নেই।


কিন্তু আজ এক পূর্ণিমারাতে, কোয়ারেন্টাইন্ড এক সময়ে, নিজেরই বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আমি ভাবছিলাম এই ছবিটার কথা। আচ্ছা, এই ছবিটায় কি কোনো মায়া আছে? ওই-যে কবিরা যেমন লেখেন, সেইরকম পথ-ভোলানো মায়া?


**

সামনে দেখা যাচ্ছে চাঁদ। অবিশ্যি তার উলটো পিঠ, যে পিঠ আমরা কখনই দেখতে পাই না। তাই কেমন যেন অধোচেনা ঠেকছে ওকে। সূর্যের আলোয় ভেসে যাচ্ছে তার শরীর। একই আলোয় দূরের পৃথিবীও থৈ থৈ করছে। কিন্তু চাঁদটা কেমন শুকনো, নিষ্প্রাণ, পাথুরে। ওর সমস্ত সোনালী হলুদ রঙ মুছে নিয়ে কে-যেন ওকে এক চিরধূসরতার অভিশাপ দিয়েছে। 


এই ছবি দেখতে কি ভালো লাগছে আমাদের? জ্যোৎস্না নেই, রূপকথা সব মুছে গেছে, চরকাকাটা বুড়ি মুখ লুকিয়েছে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে যেন এক অভিশপ্ত জড়পিণ্ড।

 



এই ছবিতে কি কোনো কবিতা আছে? থাকা সম্ভব?


ভেবে দেখলুম, এই ছবিটাই একটা পূর্ণকবিতা। মহাকাব্য বললেও ভুল কিছু হয় না। মানুষের কী অপরিসীম মহিমা, সে নিজেই তার বানিয়ে-তোলা সমস্ত মায়ারূপ ছিন্ন করে আকাশের বুকে দশ লক্ষ কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে তুলে এনেছে এই ছবি। 


প্রথমত, সত্য বলেই এ ছবি সুন্দর। কিন্তু তারই সঙ্গে সঙ্গে এই ফ্রেম যেন তৈরি করে তুলেছে এক বিকল্প মায়ার আশ্চর্য আখ্যান। 


দেখুন, সামনে  প্রাণহীন বৈচিত্র্যহীন দুচ্ছাই এক চাঁদ, পিছনে অনন্তের হা-হা করা অন্ধকার, তারই মাঝে কী আশ্চর্য পৃথিবী আমাদের। নীলের মহিমান্বিত টেক্সচারের উপর ঘূর্ণায়মান শুভ্রতার কী অপূর্ব লীলা। মন বলে ওঠে : এই তো সেই। এমন রূপময়ী আধার না-হলে প্রাণকে ধারণ করবে কে? কোনো ইন্ডিভিজুয়াল মানুষকে এই ছবিতে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না বটে, কিন্তু ওই গতিময় রঙের ছটফটানির মধ্যে যেন উদ্বেল হয়ে উঠছে চৈতন্যের নিত্যগুঞ্জরণ, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন না আপনারা বলুন? 


চাঁদ এই ছবিতে যত বেশি করে মায়াহীন পাথরের কষ্টকর সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে, ততই পৃথিবীর সৌন্দর্য অপরূপতর হয়ে উঠেছে।


গগনে চাঁদ ওঠে। কিন্তু সমস্ত অনন্তের ভিতরে কোন-এক মহালগ্নে তোমাতে-আমাতে দেখা হয় কেবল পৃথিবীরই পথে পথে। ওগো আমার সৌন্দর্যময়ী পথ-ভোলানো পৃথিবী, তোমার সমস্ত অ-সুখ আস্তে আস্তে সেরে যাক। 


আপনাদের সবাইকে আজ আকাশের পূর্ণিমা আর পৃথিবীর রাখির জন্য শুভেচ্ছা জানাই।


__________________


জয়দীপ ঘোষ

৩রা অগস্ট, ইছাপুর

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চোদ্দ ভূতের আসরে

বুদ্ধের পুতাস্থি: রাখা রয়েছে কলকাতাতেই

পার্টিশনের জীবনভাষ্য: প্রজন্মান্তরের খোঁজ