মানববাবুকে কেউ চিঠি লেখে না
১.
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় চলে গেলেন। এই মুহূর্তে কিছু লেখার মতো অবস্থা নেই। না থাকাই স্বাভাবিক কিন্তু কিছু কথা না লিখলে আমাকে সময় ছেড়ে দেবে না।
আজ বলতে দ্বিধা নেই, বাঙালিকে আন্তর্জাতিক সাহিত্যের সাথে যে ক’জন এ শহরে পরিচয় করিয়েছেন হাত ধরে, মানববাবু তাঁদের মধ্যে অন্যতম। যাদবপুরের ছাত্রদের একটা চালু প্রবাদ ছিল, মানববাবু যাকে অনুবাদ করবেন তিনিই পরের বছর নোবেল পাবেন। পাবেনই। একটা উদাহরণ না দিয়ে পারছি না, অবশ্যই মার্কেজ। অনুবাদের পরপরই নোবেল পেলেন।
যে সময়ের মানুষ মানববাবু, সে কলকাতায় অনাবিল ভাবে উৎপল দত্ত এসে তাঁকে থিয়েটারের মহড়া দেখিয়ে জানতে চাইতেন, ‘‘মানবদা দেখে দিন একটু, কিছু হচ্ছে কি না!’’ সেই কলকাতায় তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে জ্বলজ্বল করতেন বুদ্ধদেব বসু, নবনীতা দেবসেন, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিয় দেব, সুবীর রায়চৌধুরী, নরেশ গুহরা। সহজ ভাবে বাদল সরকার এসে তাঁদের ছাত্র হতে চাইতেন। ক্লাসে যতই অন্য মাস্টারমশাই তাঁরই লেখা নাটক পড়ান, তিনি ছাত্র হয়েই বসে থাকতেন চুপ করে।
বাঙালির আধুনিকতার অন্যতম স্তম্ভ এই যুগটা। যেখানে কবিতা ভবন আছে। যেখানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য আছে, যেখানে কলেজস্ট্রিটে লাতিন আমেরিকার সাহিত্য অনুবাদ হয় সারা দুনিয়ার তুলনায় অনেক আগে। মানববাবু সেই কলকাতায় দেখতেন সত্যজিৎ রায় আর রাধাপ্রসাদ গুপ্তকে সেন্ট্রাল এভিনিউ কফিহাউসে। গল্ফগ্রিনে তাঁর বাড়িতে আড্ডা মারতে এলে অনাবিল ভাবে তিনি নবারুণকে অনুরোধ করতেন মাক্স ফ্রিশের ফায়ার রেজার নাটক অভিনয় করতে। নবারুণ তা স্বীকারও করতেন। অদূরে মানববাবুর পড়শির নাম অলোকরঞ্জন, শঙ্খ ঘোষ। অরুণ মিত্র তাঁর সহজীবী। সহজীবী সমর সেন, বিষ্ণু দে। ভারতীয় ভাষার গল্প নিয়ে যেখানে তিনি সংকলন করে নজির গড়বেন। বাঙালির টাকা ছিল না। বিশ্বনাগরিকতা ছিল। ডিগনিটি ছিল। পয়সাওয়ালা ভিখিরি সেজে ব্যংকক-দুবাই গিয়ে শপিংমলে সেল্ফি তুলে ট্রোলড হত না সে বাঙালি।
মানববাবু সেই কলকাতার মানুষ। তাই এই কলকাতায় তিনি দীর্ঘকাল পরবাসী ছিলেন। স্মৃতি এলোমেলো হচ্ছিল। কথা জড়াচ্ছিল। আমার সৌভাগ্য তিনি আমার পাড়ায় থাকতেন পরের দিকে। আমি তাই সবাইকে বলতাম, ‘‘আমি মানববাবুর পাড়ায় থাকি।’’ প্রায়ই দেখতাম বাজারের ভেতর দিয়ে জেরক্স করাতে আসছেন তিনি সস্তা পোষাকে। রাস্তার লোকেরা চিনতেও পারছে না মানুষটাকে। এই মানুষটা মার্কেজের বন্ধু ছিলেন। গুন্টার গ্রাস তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে লজ্জা পেয়েছিলেন, এটা জেনে যে, তাঁর অতীতের নাৎসী জীবন জানেন মানববাবু!
বছর দুই আগে তাঁকে আমি অনুরোধ করি, একটা ইন্টারভিউ করার জন্য। তিনি অনুমতি দেন। আমি হাজির হই তাঁর ঘরে। দেড়-দু ঘন্টার সেই ইন্টারভিউ মুহূর্তে ভাইরাল হয়েছিল। ভাইরাল হওয়াটা বড়ো না, মানববাবুর কথাগুলো বড়ো। যে শহরে তাঁকে কেউ কর্নেলের মতোই আর খোঁজ নিতেন না, যে শহরে তাঁর মতো আন্তর্জাতিক সাহিত্যের এক জ্যোতিষ্ককে কেউ চিনতে পারছিল না, সেই শহরে ধীরে ধীরে নিজেকেও গুটিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে কোনো তরুণ অধ্যাপককে ফোন করে বলতেন, ‘‘কেমন আছো?’’ শুকনো গলায়।
আসলে তিনি ভালো ছিলেন না। অনেকদিন। এ শহরে অনেক গুণী-বয়স্ক-একা মানুষের মতোই। যিনি অকাতরে অনুবাদ করে গেছেন ইউরোপ-আমেরিকা-লাতিন আমেরিকা-আফ্রিকার সাহিত্য-শিল্প, তাঁর মনখারাপের অনুবাদ পড়তে পারেনি শহর। আমার নেওয়া ইন্টারভউতে তাই তাঁর সমালোচনা সুবিদিত ছিল। ‘‘শক্তির গদ্য গদ্যই না’’ বা পেটার বিক্সেল কেন তিনি অনুবাদ করেছিলেন বা কেন রবি ঘোষ এক অনাথ মহিলাকে বিবাহ করে আশ্রয় দিয়ে ভালোমনের পরিচয় দেন-সমস্তটা মন খুলে বলেছিলেন তিনি। আমি সব প্রকাশ করব না কথা দিয়েছিলাম। সে কথা আমি রেখেছিলাম। আসার আগে বলে এসেছিলাম, এক পাড়াতেই থাকি, দরকারে যে কোনও একটা ফোন করবেন। চলে আসব।
সে ফোন আর এলো না। মানববাবু চলে গেলেন। একটা যুগ শেষ হল। আন্তর্জাতিক সাহিত্যর সাথে ছিঁড়ল আরেকটা সুতো এ শহরের মেধাচর্চার। আজ তরুণ অধ্যাপক ছাত্রদের পত্রিকায় লিখতে টাকা চান। অন্যায় আবদার করেন। অথচ এ শহরে মানববাবুরা ছিলেন। ছিল কবিতা ভবন। ছিল তুলনামূলক সাহিত্য চর্চার একটা অনাবিল সরল যুগ, যেখানে টাকা না, মেধা দেখে লোকে লোককে সেলাম করত। বাংলার আকাশে মেঘ করলে জল ঝরতো লাতিন আমেরিকায়।
আপনাকে নিয়ে আমি এই গভীর শোকে অবিচুয়ারি লিখছি না। লিখছি আসলে একটা প্রলাপ, যেটা অনেকদিন মনে জমে ছিল। লিখছি একটা না-থামা কান্না। আমি আর কাউকে বলতে পারব না ‘‘আমার পাড়ায় মানববাবু থাকেন!’’
আমাদের মাপ করবেন মানববাবু। আপনাকে চিঠি লেখার যোগ্যতা এ সময়ের ছিল না। থাকবেও না। আমরা আপনাকে যোগ্য সম্মান দিতে পারিনি।
২.
তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের সমস্ত শিক্ষক ও ছাত্রদের সাথে যোগ দিয়েছিলাম মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় স্মরণে আয়োজিত ওয়েবিনারে। আমার মাস্টারমশাই এবং তাঁদের মাস্টারমশাইদের সমাবেশে ছিল আলোর মিছিল। আমি সেখানে নেহাৎই বালক। মিছিলের শেষে দাঁড়িয়ে জানালাম আমার নেওয়া মানববাবুর শেষ ইন্টারভিউয়ের স্মৃতি আর একই পাড়ার বাসিন্দা হওয়ায়, অসহায় এই জিনিয়াসকে রাস্তা-ঘাটে একা হেঁটে যাওয়া দেখার বিষাদ। আমার বিশ্বাস, মানববাবু আরেকটু বাঁচতেন। বড়ো দ্রুত তাঁর এই চলে যাওয়া। এখনও আমার শোক কাটেনি। অমিয় দেব ছাড়া তাঁর প্রজন্মের আর সেই ধ্রপদী আধুনিক বাঙালিদের কেউ থাকলেন না। আর শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্যই।
যাদবপুর আর বিশ্বভারতীর এই আয়োজন আমায় শুশ্রূষা দিল। বলাই বাহুল্য। মানববাবুই আসলে কর্নেল, আমার বারবার মনে হতো। যাকে কেউ চিঠি লেখে না আর। আমার পাড়াটাকে মনে হত, মানববাবুর লাতিন আমেরিকা। সবাইকে বলতাম, আমি মানববাবুর পাড়ায় থাকি, যেখানে মিলে যেত লাতিন আমেরিকা থেকে ইউরোপ–সব। যেখানে মার্কেজের এই প্রবীণ বন্ধু, বাঙালির আদি ও আবহমান এই অনুবাদক যিনি বিশ্বসাহিত্য পড়াতে শেখালেন, একলা বাজার করতেন ধীর পায়ে হেঁটে… যে পাড়ায়, একশো বছরের নিঃসঙ্গতা রেখে চলে গেলেন তিনি…
______________
দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়, লেখক-সাংবাদিক
কলকাতা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন