শতবর্ষের মশাল: ইস্টবেঙ্গল
ছোটোবেলায় স্কুলে পড়তে কুইজে একটা প্রায় ধাঁধার মতো প্রশ্ন করা হত, ‘বলো তো ভারতবর্ষের কোন রাজ্যের নাম ভৌগোলিকভাবে ভুল’, ভ্যবাচ্যাকা খাওয়ানো এই প্রশ্নের উত্তর যে হবে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ তা বলে দেওয়ার পর মনে হত প্রশ্ন হিসেবে এটি অত্যন্ত অনৈতিক। প্রশ্নকর্তা তখন বুঝিয়ে বলতেন দেশের মানচিত্রের পূর্বপ্রান্তে থেকেও রাজ্যের নাম ‘পশ্চিমবঙ্গ’— কাজেই এটি ভৌগোলিকভাবে ভুল। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে? ভৌগোলিকভাবে ভুল হলেও ঐতিহাসিকভাবে কি সঠিক হতে পারে না? ঠিক-ভুলের বিচারে ভূগোল যেমন বিচার্য তেমনই বিচার্য ইতিহাসও। ঘটনাচক্রে যে ইতিহাস বহু বেদনার, বহু বহু যন্ত্রণার। পার্টিশন বিশেষজ্ঞ উর্বশী বুটালিয়ার ভাষায় সেই ইতিহাস “difficult to forget but dangerous to remember” (Urvashi Butalia, The Other Side of Silence, Penguin, 1998, page 357) – কারণ সেই ইতিহাস ভাগের তথা বিচ্ছেদের ইতিহাস, উৎখাত হওয়ার ইতিহাস। কালের গতিপথে আজ হয়তো সেই ইতিহাস মুছে দেওয়ারই সময় এসেছে, যে কারণে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ বা ‘West Bengal’-এর নাম পরিবর্তনের সুপারিশ সংক্রান্ত আলোচনা সাংস্কৃতিক এবং প্রশাসনিক স্তরে গত কয়েক দশক ধরে খুব জোরালো হয়েছে। কেননা পশ্চিমবঙ্গের বিপরীতে কোন পূর্ববঙ্গের অস্তিত্ব এখন আর নেই, নেই কোন ইস্টবেঙ্গল। বিভাজিত বঙ্গের পূর্বভাগ এখন স্বাধীন বাংলাদেশ, তার নিজস্ব আইডেনটিটি, নিজস্ব সত্তা, সংকট, মানচিত্র নিয়ে সে পৃথক। কিন্তু তবু সেই ভূখণ্ড, স্মৃতির প্রদেশে কারও কারও ভাষায় আজও ‘আমাগো দ্যাশ’, পার্টিশন সেই ‘দ্যাশ’ কেড়ে নিয়েছে বটে, মাটি থেকে উপরে তাঁকে করে তুলেছে কলোনির কোলাহলে মিশে থাকা এক বিধ্বস্ত প্রজন্মের নাগরিক, বহু অপমানে, বহু সংঘাতে, বহু তরজায় হেরে যেতে থাকার হাজারও গ্লানির মাঝে তবু সে বলে ‘আমাগো দ্যাশ’ – কেননা ‘দেশ’ মানে তো কেবল বাসভূমি নয়, দেশ তো কেবল মানচিত্র নয়। দেশ এক ধারণার নাম, চেতনায় আঁকা হয় যার মানচিত্র, ইস্টবেঙ্গল তাই না থেকেও আছে। আছে বলেই সে নামের সমনামী ফুটবল ক্লাব নিছক একটা ক্লাবের নাম হয়ে থাকে না আর, ইতিহাসের পাতায় শতাব্দী পেরোনো ইস্টবেঙ্গল ফুটবল ক্লাব তাই একটা সত্তা চিহ্নের প্রতীক। হ্যাঁ ইস্টবেঙ্গল গর্বের সঙ্গে ‘বাঙালদের ক্লাব’, হ্যাঁ ইস্টবেঙ্গল ‘আমাগো কেল্যাব’। এই প্রাদেশিকতাকে কেউ ক্ষুদ্র বলতেই পারেন, কিন্তু ইতিহাস বলে অন্য কথা। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই পরিচয়। এই পরিচয় তাই ভোলার নয় মোছারও নয়।
শতবর্ষ অতিক্রম করছে ইস্টবেঙ্গল ফুটবল ক্লাব। নানা মাধ্যমে সে নিয়ে চলছে লেখালিখি, সেই ভিড়ে আমাদের এই লেখাও সামিল। কিন্তু কিছুটা ভিন্ন স্বর নিয়ে। শতবর্ষ আগের ইতিহাস, গর্ব, স্পর্ধা আর আবেগের কাহিনি আমরা অবশ্যই তুলে ধরব, কিন্তু সেই সঙ্গেই তুলে ধরব দেশভাগ, পার্টিশন, উদ্বাস্তু নাগরিকের সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে যায় ‘ইস্টবেঙ্গল’, কেন নিছক ফুটবলের পরিসরে সীমিত থাকে না এই চিহ্নায়ন, খুঁজব সেই সমাজতাত্ত্বিক রাজনৈতিক উত্তরও।
এক
ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে অবধারিতভাবে এসে পড়বে ‘বাঙাল-ঘটি’ প্রসঙ্গ। Social Identity বা সামাজিক চিহ্নক হিসেবে বাঙাল-ঘটি নিয়ে সিরিয়াস অ্যাকাডেমিক চর্চার বেশ অভাব রয়েছে, তুলনায় ব্যাপারটা লঘু তরজার পরিসরে বেশি আলোচ্য। যদিও ঐতিহাসিকভাবে এই সামাজিক চিহ্নক, বিশেষ করে বাঙাল আইডেনটিটি-টি সাহিত্য সংস্কৃতির পরিসরে যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, সে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কমিডি হোক বা টেনিদার গল্পে বাঙাল হাবুল হোক— সর্বত্রই সে হাসির খোরাক, নিছক মজা তৈরির উপকরণ, অপর অংশের দ্বারা অবদমিত, প্রান্তীয়। এই নিয়ে সমাজতাত্ত্বিক রাজনৈতিক চর্চা ভীষণ প্রয়োজন। যদিও আজকের দিনে আর এই চিহ্নায়নের স্বতন্ত্র ভিত্তি আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে, কিন্তু না-থাকলেও কেন নেই, আর্থসামাজিক ইতিহাসের নিরিখে সেই প্রশ্নটিও জরুরি। বাঙাল-ঘটি চিহ্নায়নকে বিশ্লেষণ করা হয় নানা প্রেক্ষিত থেকে, ভাষা তার মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও আছে রান্না, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি নানা ক্ষেত্র। সেই সঙ্গে আছে প্রতিবেশিদের আজন্ম ঠেস— ‘ওরা বাঙাল, ওরা ট্রাকে করে এসেছে, উড়ে এসে জুড়ে বসেছে’। ঘনিয়ে তোলা সাম্প্রতিক এনআরসি বিতর্কে যে ঠেস শুনে হজম করেছে একেবারে স্বাধীন ভারত ভূখণ্ডে জন্ম নেওয়া বর্তমান প্রজন্মও। বস্তুত ‘বাঙাল’ শব্দটির মধ্যেই মিশে আছে ঈষৎ ‘অবজ্ঞা’, বিপরীতে ‘ঘটি’ শব্দেও তাই। অভিধানও সে সাক্ষ্য দেয়। কাজী আব্দুল ওদুদ-এর সংকলিত ও অনিলবরণ ঘোষ শোধিত ও পরিবর্ধিত ‘ব্যবহারিক শব্দকোষ’- বলছে ‘ঘটি’ শব্দের অর্থ ‘পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় পশ্চিমবঙ্গের লোক (অবজ্ঞার্থে)। বিপরীত বাঙাল।’ বঙ্গীয় শব্দকোষ প্রণেতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও ‘বাঙাল’ সূত্রে পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদের কথাই বলেছেন। এই সূত্রে মনে হতে পারে ঘটি-বাঙাল চিহ্নায়ন বুঝি দেশভাগের পরিণামে রূপ নেওয়া সাংস্কৃতিক বিবাদ, কিন্তু আদৌ তা নয়। ‘ঘটি’ শব্দটি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ‘বাঙাল’ আইডেনটিটিটি দীর্ঘদিনের, মধ্যযুগের সাহিত্যেও এর নজির রয়েছে। কবিকঙ্কনের চণ্ডীমঙ্গল, মনসার ভাসান, চৈতন্যভাগবত, গোপীচন্দ্রের গান সর্বত্রই ‘বাঙাল’ শব্দটির দেখা মেলে। কাজেই নদীর বিভাজন রেখায় পশ্চিম বনাম পূর্ব – বাংলা ভূখণ্ডের এই সমাজতাত্ত্বিক বিভাজনের একটি ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক ভিত্তি রয়েছে, রয়েছে রাজনৈতিক ভিত্তিও— একথা বলাই যায়। দেশভাগ বা পার্টিশনের অভিঘাতের বহু বহু আগেই বর্তমান অর্থে ‘বাঙাল’ শব্দটির প্রয়োগ দেখি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও দীনবন্ধু মিত্রের লেখায়। ‘সধবার একাদশী’তে দীনবন্ধু মিত্র লিখছেন, ‘এস এস, রামমাণিক্য বাবু এস – (মুখের আঘ্রাণ গ্রহণ) ব্যাটা ধেনো খেয়ে মরেচে, ব্যাটা বিক্রমপুরের বাঙ্গাল—’ (ক্ষেত্র গুপ্ত (সম্পাদিত), দীনবন্ধু মিত্র রচনাবলী, কলকাতা: সাহিত্য সংসদ, ষষ্ঠ মুদ্রণ, ২০০৬, পৃ. ১৩৫)। ‘বাঙাল’ নিয়ে শ্লেষাত্মক, বিদ্রূপাত্মক ছড়া আর প্রবাদ তৈরিও এই সময় থেকেই শুরু হয়ে যায়, এই সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রসমীক্ষাভিত্তিক কাজ করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দুই গবেষক অভিজিত সাধুখাঁ এবং অভিজিত ব্যানার্জি (‘ঘটি-বাঙালের সামাজিক চিহ্নক: ইতিহাস, প্রেক্ষিত, প্রাসঙ্গিকতা’, মননকুমার মণ্ডল (সম্পাদিত), পার্টিশন সাহিত্য: দেশ-কাল-স্মৃতি, কলকাতা: গাঙচিল, সেপ্টেম্বর ২০১৪, পৃ. ৩২৬)
তাঁদের মতে “দেশভাগ পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে বাঙাল-ঘটি আরও ব্যাপক সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।”
এই মত স্বীকার করে নিয়েও বলা যায় দেশভাগ বাঙাল-ঘটি সামাজিক চিহ্নককে বিশেষ অভিঘাত দিলেও মোটের উপর উনিশ শতকের কলকাতা-কেন্দ্রিক নবজাগরণ ও কলকাতা-কেন্দ্রিক সাহিত্য সংস্কৃতির মূলস্রোতী নির্মাণের প্রেক্ষাপটেই সেইসময় থেকেই আর্থসামাজিক প্রয়োজনে বাংলার ‘পূর্বখণ্ড’ থেকে কলকাতায় আসা মানুষজন চিহ্নিত হতে থাকেন ‘বাঙাল’ বলে, এই ‘আদারাইজেশন’ নিঃসন্দেহে একটি অর্থনৈতিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। আর এই প্রক্রিয়াই উনিশ শতক পেরিয়ে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের অন্তিম বছরে অর্থাৎ ১৯২০-তে জন্ম দিয়েছিল ‘ইস্টবেঙ্গল’ ক্লাবের। হ্যাঁ ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্মই হয়েছিল ‘বাঙাল’ আইডেনটিটিকে সম্বল করে, একারণেই লেখার শুরুতে বলেছি ইস্টবেঙ্গল ফুটবল ক্লাব একটা সত্তা চিহ্নের প্রতীক। এই ক্লাবের জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই পরিচয়। কালের যাত্রাপথে আজ আর এই পরিচয় সামাজিক-রাজনৈতিক ভাবে প্রাসঙ্গিক কিনা জানি না কিন্তু এই পরিচয় ঐতিহাসিক।
বাঙাল বিপ্লব—ইস্টবেঙ্গলের জন্ম
উনিশ শতকের বাঙালির খেলাধূলার ইতিহাস নিয়ে সাম্প্রতিককালে চর্চা হয়েছে বিস্তর, নতুন সামাজিক ইতিহাসের পরিসরে খেলাধূলার ইতিহাস স্থান করে নিয়েছে বিশেষভাবে। সেই ইতিহাস বলে, উনিশ শতকে সাহেবি ক্রীড়া সংস্কৃতির অনুগামী এবং প্রতিস্পর্ধী দুরকম প্রভাবেই উত্তর কলকাতার ধনী বাবুরা তৈরি করেছিল একের পর এক ক্লাব। ১৮৮৫ তে তৈরি হওয়া শোভাবাজার ক্লাব, ১৮৮৯-এ জন্ম নেওয়া মোহনবাগান ক্লাব— প্রাথমিকভাবে প্রতিটি ক্লাবই ছিল দেশীয় আইডেনটিটির ধারক। স্বদেশী ক্লাব। ১৯১১ সালে মোহনবাগান ক্লাবের আই এফ এ শিল্ড জয় তাই একটি জাতীয় বিজয়, ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ মনে করেন মোহনবাগানের ফুটবল বিজয়কে কেন্দ্র করে তৎকালীন কলকাতায় যে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার উন্মেষ দেখা গিয়েছিল, ১৯১১-তে কলকাতা থেকে দিল্লিতে উপনিবেশের রাজধানী স্থানান্তরের পিছনে সেটিও ছিল একটি কারণ। এই সংক্রান্ত আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন সৌমেন মিত্র, তাঁর ‘ঔপনিবেশিক বাংলার ফুটবল, জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও উপপ্রাদেশিকতা’ বইতে। ইস্টবেঙ্গলের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগান তাই সেই সময়ে ঘটিদের ক্লাব নয় বরং জাতীয় ক্লাব হিসেবেই পরিচিত হয়েছিল। কিন্তু মোহনবাগানসহ অন্যান্য ক্লাবগুলির ক্রমশ ‘ঘটি’ হয়ে ওঠার মধ্য দিয়েই বিপরীত বিন্যাসে ঘটেছিল বাঙাল বিপ্লব— জন্ম হয়েছিল ইস্টবেঙ্গলের।
সাল ১৯২০। কোচবিহার কাপের সেমিফাইনাল ম্যাচ। মুখোমুখি ক্যালকাটা ক্লাব ও জোড়াবাগান ক্লাব। জোড়াবাগানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ছিলেন ‘বাঙাল’ শৈলেশ বসু। গুরুত্বপূর্ণ সেই ম্যাচে প্রথম একাদশের বদলে তাঁর জায়গা হল রিজার্ভ বেঞ্চে। এমনটা নাকি প্রায়ই হয়। শুধুমাত্র পূর্ববঙ্গীয় বলেই। খবর পৌঁছল ক্লাবের সহ-সভাপতি সুরেশচন্দ্র চৌধুরীর কানে। ইনি নিজেও ছিলেন পূর্ববঙ্গীয় – ‘বাঙাল’। ময়মনসিং জেলার টাঙ্গাইল মহকুমার নাগপুর গ্রামের জমিদার ছিলেন তিনি। সুরেশ চৌধুরী ছিলেন ফুটবল অন্তপ্রাণ। ভালো খেলার জন্য শৈলেশ বসুকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন। খোঁজ নিয়ে সুরেশবাবু জানতে পারলেন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে শৈলেশ বসুকে বাদ দেওয়ার পিছনে ‘বাঙাল’ আইডেনটিটির অভিযোগ সত্যি। জাত্যাভিমানে ঘা পড়ল। ক্ষিপ্ত সুরেশচন্দ্র চৌধুরী মনে মনে তখনই সিদ্ধান্ত নেন ক্লাব ছাড়বেন। তবু পরিস্থিতি সামাল দিতে ফাইনালে নামানো হল শৈলেশ বসুকে। সেই সঙ্গে আরেক বাঙাল নসা সেনকে।
১৯২০-র ২৮ জুলাই কোচবিহার কাপে মোহনবাগান ক্লাবের সঙ্গে জোড়াবাগানের ফাইনাল খেলা চলছিল।
ম্যাচে জোড়াবাগান হেরে যাওয়ার পর সব দায় চাপানো হয় দুই বাঙাল খেলোয়াড় শৈলেশ বসু ও নসা সেন-এর ঘাড়ে। আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল— জ্বলে উঠল লাল-হলুদ মশাল। বাঙাল খেলোয়াড়দের নিয়ে জোড়াবাগান ক্লাব ছেড়ে বেরিয়ে এলেন সুরেশচন্দ্র চৌধুরী ও রমেশচন্দ্র বসু।
ধনী জমিদার সুরেশচন্দ্র চৌধুরীর ২০ নম্বর নিমতলা স্ট্রিটের বাড়িতেই, ২৮ জুলাই হয় সেই ঐতিহাসিক মিটিং, যে মিটিং-এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয় নতুন ক্লাব গঠনের, এই মিটিং-এই শৈলেশ বসু নতুন ক্লাবের নাম প্রস্তাব করেন ‘ইস্টবেঙ্গল’, নাম শুনে নসা সেন কিছুটা প্রাদেশিকতার অভিযোগ তুললেও, নামের মধ্যে নিহিত থাকা পূর্ববঙ্গীয় আবেগের কারণেই সুরেশচন্দ্র চৌধুরীর দারুণ পছন্দ হয়ে গেল নামটি। আপত্তি অভিযোগ বিতর্ক দূরে সরিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হল পূর্ববঙ্গের খেলোয়াড়দের বঞ্চনার প্রতিবাদে গঠন হচ্ছে নতুন ক্লাব, নাম ইস্টবেঙ্গল।
কয়েকদিন আরও কিছু আলোচনার পর ১৯২০-র ১ আগস্ট জন্ম নিল বাঙালদের ক্লাব ইস্টবেঙ্গল। ২০ নম্বর নিমতলা স্ট্রিটের সুরেশচন্দ্র চৌধুরীর সেই বাড়িটি এখন পরিচিত ‘লাল-হলুদ বাড়ি’ নামে, ঐতিহাসিক এই বাড়িটিই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের আঁতুড়ঘর। মোহনবাগানের ইতিহাসকে সম্মান জানাতে যেমন মোহনবাগান রো , মোহনবাগান লেন, শিবদাস ভাদুড়ী স্ট্রিট কলকাতার মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে তেমনই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ইতিহাসকে সম্মান জানাতে নিমতলা স্ট্রিটের নাম সুরেশচন্দ্র চৌধুরীর নামে নামাঙ্কিত করার দাবি দীর্ঘ দিনের, যদিও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
ক্লাবের জন্মের পর সুরেশবাবু ভেবেছিলেন পূর্ববঙ্গের ফুটবলারদের এক ছাতার তলায় আনবেন। সেসময় মোহনবাগান, এরিয়ান্স, কুমোরটুলি, টাউন, জোড়াবাগান ও শোভাবাজারে প্রচুর পূর্ববঙ্গের ফুটবলার খেলতেন। কুমোরটুলি পার্কে ছোটদের একটা ক্লাব ছিল। নাম ছিল ক্যালকাটা ইউনিয়ন। সুরেশবাবু ঠিক করেন এই ক্লাবকেই তিনি অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবেন। নিজের নতুন সংগঠনেকে জুড়ে দিলেন এর সঙ্গে, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্র্যাকটিস শুরু হয় কুমোরটুলি পার্কে। পার্কের বাইরে একটি প্রস্তরফলকে আজও সেই ইতিহাস ধরা আছে।
সেই সময় সুরেশবাবুর কলকাতায় বেশ নামডাক ছিল। ধনীদের একজন হিসেবেই গণ্য করা হতো তাঁকে। আর্থিক উপার্জনের কারণে পূর্ববঙ্গের আরও অনেক মানুষও তখন কলকাতায়। তাঁরাও এগিয়ে এলেন সুরেশবাবুর পাশে। এঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হলেন বাংলাদেশের রায়বাহাদুর দাপুটে ব্যারিস্টার তড়িৎভূষণ রায়। অভয়মিত্র লেনে অবস্থিত তাঁর বাড়িতেই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রথম অফিসিয়াল মিটিংটি হয়েছিল ১৯২০-র সেপ্টেম্বর মাসে, তড়িৎভূষণ রায়ই তৈরি করেছিলেন ক্লাবের সংবিধান সংগঠন, নিয়মাবলি, রেজিস্ট্রেশনের কাগজপত্র। অভয়মিত্র লেনে রায়দের দুটি বাড়ি ছিল, একটি ২ নম্বর আরেকটি ৬ নম্বর। কোন বাড়িতে সেই ঐতিহাসিক মিটিংটি হয়েছিল আজ আর জানার উপায় নেই, রায়দের ২ নম্বর বাড়িটি যদিও ইতোমধ্যেই ভেঙে ফেলে সেখানে নতুন বিল্ডিং তোলা হয়েছে। আমাদেরই অপদার্থতায় কালের গর্ভে তাই হারিয়ে গিয়েছে সোনালি লাল-হলুদ ইতিহাস। তবু যেটুকু ধরা আছে তা থেকে জানা যায়:
ক্লাবের প্রথম সভাপতি ছিলেন: অধ্যক্ষ সারদারঞ্জন রায়।
যুগ্ম-সম্পাদক: সুরেশচন্দ্র চৌধুরি ও তড়িৎভূষণ রায়।
কার্যকরী সমিতি সদস্য: নন্দলাল রায়, ননীলাল রায়, কেশব গোস্বামী, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ রায় চৌধুরি, বনোয়ারিলাল রায়, বিজয় রায়, শৈলেশ বসু, ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ রায় চৌধুরি, নসা সেন, পুলিন বিহারী রায় ও পঙ্কজ গুপ্ত।
(তথ্যসূত্র: ‘ক্লাবের নাম ইস্টবেঙ্গল’, শান্তিপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়)
দুই
কেবল বাঙাল আইডেনটিটিকে সম্বল করে ইস্টবেঙ্গলের পথ চলা শুরু হওয়ায় কলকাতার মাটিতে প্রথমদিকে এর সমর্থক সংখ্যা ছিল নগণ্য। বিখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক রূপক সাহার মন্তব্য এ প্রসঙ্গে এখানে উল্লেখ করছি:
একটা প্রশ্ন প্রায়ই আমাকে কুরে কুরে খায়। বাঙালদের ক্লাব করার কথা যখন সুরেশ চৌধুরী বা তড়িৎ ভূষণ রায়রা ভাবেন, তখন পূর্ববঙ্গের কোনো শহরের কথা তাঁরা মাথায় আনেননি কেন? স্বচ্ছন্দে ঢাকা শহরেও তাঁরা ক্লাব প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। ঢাকার ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং, ওয়ারী ক্লাবের নাম তখন সারা বাংলায় পরিচিত। রংপুরের একটা ক্লাব তাজহাট স্পোর্টিং তো তখন কলকাতার লিগে দ্বিতীয় ডিভিশনে খেলত। ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব ঢাকায় হলে একদিকে যেমন অনেক বেশি জনসমর্থন পেত, অন্যদিকে কলকাতার লিগে খেলার সুযোগও। হয়তো মোহনবাগানকে সহবত শেখানোর ইচ্ছাটাই প্রবল হয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন সুরেশবাবুদের কাছে। ঘটিদের জমিতে বসে ঘটিদের দাঁত ওপড়ানোর বিষয়টাই প্রাধান্য পেয়েছিল তাঁদের মনে। জন্মলগ্নেই একটা দাঁত তাঁরা উপড়ে নেন মোহনবাগানকে হারকিউলিস কাপে হারিয়ে। সুরেশ চৌধুরীরা জানতেন, পূর্ববঙ্গ থেকে ফুটবলার নিয়ে এসে দম্ভ দেখানোর প্রক্রিয়াটা বন্ধ করে দিতে পারলেই মোহনবাগানকে জব্দ করা যাবে। সে কারণে বাঙাল ফুটবলারদের জন্য এই ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। (প্রথম আলো, ‘ঘটি-বাঙাল লড়াই থেকে জন্ম নেওয়া ক্লাবের ১০০ বছর’, রূপক সাহা, প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০১৯)
কিন্তু রূপক সাহা-র সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করে বলা যায় বাঙাল পরিচয় নিয়ে জন্মালেও এবং মোহনবাগান, জোড়াবাগানকে চিরশত্রু ঘোষণা করলেও প্রথমেই মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের মধ্যে ঘটি-বাঙালের লড়াই শুরু হয়ে যায় নি। এই সংঘাতের সমাজতাত্ত্বিক রাজনৈতিক নির্মাণ আরও কিছুটা পরে—পার্টিশন, দেশভাগের ঐতিহাসিক অভিঘাতে নির্মিত। বিপুল উদ্বাস্তু স্রোতে পশ্চিমবঙ্গের পাল্টে যাওয়া জনবিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতেই ঘরে বাইরে উঠতে বসতে ‘বাঙাল’ আইডেনটিটির ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার যন্ত্রণা থেকেই ‘ইস্টবেঙ্গল’কে আঁকড়ে ধরা, কলোনির ঘরে ঘরে তখন ফুটবল আর ইস্টবেঙ্গল ক্লাব সমার্থক। ছিন্নমূল উদ্বাস্তু মানুষরা ইস্টবেঙ্গল নামটির মধ্যেই পেলেন ফেলে আসা দেশের গন্ধ। ঘাড় নিচু করে কাঁটাতার পেরতে বাধ্য হওয়া অসহায় মানুষের কাছে একটা স্পর্ধার নাম হয়ে উঠল ইস্টবেঙ্গল ক্লাব, একদিন যার জন্ম হয়েছিল বাঙালদের আত্মসম্মানের অধিকারেই।
তাই বহু পরের ছিন্নমূল উদ্বাস্তু জীবনের ট্রাম-বাস-কলোনির ছোটো ঘরের সংসারের কাহিনির সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে মিশে যায় ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। হয়ে ওঠে বাঙালদের ক্লাব। বিপরীতে মোহনবাগান হয়ে ওঠে চিরশত্রু, ‘ঘটি’দের ক্লাব। একথা তাই বলাই যায় যে দেশভাগের মতো ঘটনা না ঘটলে হয়তো আজ ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ইতিহাস অন্যখাতে বাহিত হত।
মেমরি কেন্দ্রিক উদ্বাস্তু জীবনের প্রাত্যহিক যাপনে, কোনো এক ফেলে আসা দেশ, যে দেশ আসলে হয়তো তেমন ছিল না যেমনটা এখন স্মৃতির বুননে তাকে সাজাচ্ছি, তবু সে দেশ, স্মৃতির হাত ধরে মননের মাঝে হয়ে ওঠে ‘আমাদের দেশ’, ‘আমাগো দ্যাশ’। ঠিক সেভাবেই ইস্টবেঙ্গল ক্লাব হয়ে ওঠে ‘আমাগো কেল্যাব’। এই নির্মাণে বিপরীত ‘অপর’-এর প্রতি যেমন মিশে থাকে বিগত ঘৃণা, অসম্পূর্ণ আক্রোশ, অসহায় কান্না, শিকড় ছিঁড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা, তেমনই মিশে থাকে এখনের ছিন্নমূল প্রজন্মের কাছে, কলোনির ঘুপচি ঘরের ভিতর নোয়ানো মাথার উঠে দাঁড়ানো চেষ্টা, স্পর্ধা, আর সংগ্রাম। “তোরা তো সব ওদেশে জমিদার ছিলিস” ব্যঙ্গের সান্নিধ্যে বড়ো হয়ে ওঠে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মেও তাই সঞ্চারিত হয় এই আবেগ। ঠিক যেভাবে যাপিত বাস্তবতায় পার্টিশনকে না পেয়েও যাপনের অঙ্গে বেঁচে থাকে পার্টিশন, ঠিক সেভাবেই মেসি-রোনাল্ডো ভক্ত একুশ শতকের প্রজন্মও এখনও ইস্টবেঙ্গল বলতে ভাসেন আবেগে।
মেমরি থেকে পোস্ট মেমরির এই যাত্রাপথে ‘ইস্টবেঙ্গল’ আইডেনটিটিকে উত্তরপ্রজন্ম ধারণ করে তার সত্তায়। কলোনির বাসাবাড়ি থেকে টুবিএইচকে ফ্ল্যাটে উঠে এসেও যাপনে-সঙ্গোপনে বহমান থাকে সেই পরিচয়। ভিড়ে মিশে যেতে যেতেও আলতো একটা-আধটা কথায়, উচ্চারনে, বাক্ভঙ্গিতে, রান্নার স্বাদে, পার্বণে, উৎসবে, অভিমানে, ঘৃণায় হঠাৎই উঁকি দিয়ে যায় পার্টিশনের কাঁটাতার পেরোনোর দাগ। শতাব্দী পেরোনো ইস্টবেঙ্গল ক্লাব সেই কাঁটাতারের স্মৃতির উপর নেমে আসা আশ্রয়ের মলম-এর মতো, একারণেই ক্রীড়া সাংবাদিক রূপক সাহা বলেন:
ইস্ট বেঙ্গলকে কেন জানি না আমার ব্রাজিলের ফ্ল্যামেঙ্গো ক্লাবের মতো বলে মনে হয়। জনতার ক্লাব, খেটে খাওয়া মানুষের জন্য, তৈরিও তাদের হাতে। যাদের সঙ্গে তুলনাটা করছি, তারা ইতিমধ্যেই শতবর্ষ অতিক্রম করে গেছে। ট্রফি জেতার নিরিখে ফ্ল্যামেঙ্গোর হয়তো সেই অতীত গরিমা আর নেই। কিন্তু তাদের জনসমর্থনে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। সেই সঙ্গে ক্লাবের প্রতি আনুগত্যেও। (প্রথম আলো, ‘ঘটি-বাঙাল লড়াই থেকে জন্ম নেওয়া ক্লাবের ১০০ বছর’, রূপক সাহা, প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০১৯)
স্পর্ধার রঙ লাল হলুদ: জার্সি, প্রতীক ও পথচলা
কেমন ছিল এই ক্লাবের প্রথম দিকের চলার পথ? শতবর্ষ আগের ময়দানের ডায়রি বলছে ইংরেজদের অধীনে চলা ফুটবল প্রতিযোগিতাগুলিতে তখন নেটিভ ক্লাবের সংখ্যা বেঁধে রাখা হত। চাইলেই তাই খেলা যেত না। একমাত্র যদি না অন্য কোনো নেটিভ ক্লাব লিগ থেকে নাম তুলে নেয় তবেই শিকে ছিঁড়ত নতুন কোনো ক্লাবের। ইস্টবেঙ্গল কর্তা সুরেশবাবু খোঁজ করে জানতে পারলেন, রংপুরের তাজহাট স্পোর্টিংকে নাম তুলে নেওয়ার প্রস্তাবটা দেওয়া যেতে পারে। তখন ওই ক্লাব চালাতেন রাজা গোপাল রায়। তাঁকে নানাভাবে বুঝিয়ে সুরেশবাবু শেষ পর্যন্ত রাজি করিয়ে ফেললেন এবং এর ফলেই ইস্টবেঙ্গল কলকাতা লিগে দ্বিতীয় ডিভিশনে খেলার প্রথম সুযোগ পায় ১৯২১ সালে, প্রথম অধিনায়ক ছিলেন নসা সেন।
প্রথম দিকে ইস্টবেঙ্গলের কোন জার্সি ছিল না। বিশ্বের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি ইস্টবেঙ্গল সমর্থককে যে জার্সির রঙ আজ উদ্বেলিত করে সেই ঐতিহাসিক লাল-হলুদ জার্সি কীভাবে ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে জড়িয়ে গেল সেই সংক্রান্ত একটি চলতি গল্প আছে। সেই সঙ্গে আছে ক্রীড়া গবেষক রূপক সাহার উদ্ধার করা আরেকটি রোমাঞ্চকর গল্প। কোনটি সত্যি তা আমাদের জানা নেই, পাঠকদের সামনে আমরা দুটিই উল্লেখ করছি।
শান্তিপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘ক্লাবের নাম ইস্টবেঙ্গল’, বই থেকে জানা যায়, ১৯২০ সালের হারকিউলিস কাপ-এ নাম দেয় ইস্টবেঙ্গল। এই প্রতিযোগিতায় নামার আগে ক্লাবকর্তারা ঠিক করেন, ক্লাবের নির্দিষ্ট জার্সি করা হবে। এরপর কোনও এক বিকেলে ক্লাবকর্তা সুরেশচন্দ্র চৌধুরি চৌরঙ্গী এলাকায় জার্সির খোঁজে বেরোন। নানা দোকান ঘুরলেও কোনও জার্সিই পচ্ছন্দ হচ্ছিল না। সুরেশবাবু চেয়েছিলেন এমন উজ্জ্বল রঙের একটা জার্সি, যা চোখ ধাঁধিয়ে দেবে।
শেষপর্যন্ত সেকালের বিখ্যাত মণিহারী দোকান হোয়াইটওয়ে লেইডল-তে এক সেট জার্সি পছন্দ হয়। ঠিক ধর্মতলার মোড়ে অবস্থিত আজকের মেট্রোপলিটান বিল্ডিংই ছিল সে যুগের হোয়াইটওয়ে লেইডল ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। পছন্দ হওয়া জার্সির সেসময় দাম পড়েছিল ৮০ টাকা। চলতি বাজার দরের প্রায় দ্বিগুন দাম। কিন্তু ধনী কর্মকর্তাদের পচ্ছন্দটাই আসল, কাজেই চড়া দামেই কেনা হল সেই লাল-হলুদ জার্সি। এই জার্সিতেই ইস্টবেঙ্গল প্রথমবার হারকিউলিস কাপ খেলতে নামে এবং চ্যাম্পিয়ন হয়। কাজেই ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী হয়ে যায় সেই জার্সি। শতাব্দী পেরিয়ে যে জার্সি আর তার লাল-হলুদ রঙ আজ দেশ-বিদেশের কোটি কোটি সমর্থকের আবেগের রঙ, ভালোবাসার রঙ, স্পর্ধার রঙ।
কিন্তু একটা অন্য গল্প শুনিয়েছেন বিখ্যাত ক্রীড়া গবেষক, ‘ইতিহাসে ইস্টবেঙ্গল’- বইএর লেখক রূপক সাহা, আমরা তাঁর বক্তব্য উদ্ধৃত করছি:
ইস্টবেঙ্গলের জার্সির রং কেন লাল-সোনালি, এ নিয়ে অনেক মত আছে। ক্লাব থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়, ক্লাবের জার্সি কেনার জন্য কর্তারা যখন এসপ্ল্যানেডের এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোর হোয়াইটওয়ে লেডলেতে যান, তখন লাল-সোনালি রঙের একটা জার্সি তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ওই জার্সিই তাঁদের পছন্দ হয়ে যায়।
কিন্তু আমি যখন ‘ইতিহাসে ইস্ট বেঙ্গল’ বইটা লিখি, সে সময় প্রবীণ এক কর্তার মুখে শুনেছিলাম অন্য কথা। ক্লাব প্রতিষ্ঠার প্রথম মিটিং হয়েছিল উত্তর কলকাতার কুমোরটুলিতে ব্যারিস্টার তড়িৎ ভূষণ রায়ের বাড়িতে। সেদিন ছিল ঝুলন উৎসব। মন্দিরে রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ সাজানো লাল-হলুদ ফুলে। নাটমন্দিরজুড়ে রাধাচূড়া আর কৃষ্ণচূড়া ফুল। মিটিং থেকে বেরিয়ে কর্তাদের চোখে ঘোর লেগেছিল। পরে লাল-হলুদ রঙের জার্সি বেছে নেওয়ার পেছনে কাজ করেছিল সেদিনের মুগ্ধতা। (প্রথম আলো, ‘ঘটি-বাঙাল লড়াই থেকে জন্ম নেওয়া ক্লাবের ১০০ বছর’, রূপক সাহা, প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০১৯)
জার্সির নিয়ে ভিন্ন মত থাকলেও ইস্টবেঙ্গলের প্রতীক কেন জ্বলন্ত মশাল, তা নিয়ে কোনো মতপার্থক্য নেই। ১৮৮৯ সালে যখন মোহনবাগান ক্লাবের জন্ম হয় তখন তাদের প্রতীক ছিল বসে থাকা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। কিন্তু টিপু সুলতানের সেনাবাহিনীর প্রতীকও যেহেতু বাঘ কাজেই ইংরেজদের ‘অনুরোধে’ বাঘ বদলে গেল পালতোলা নৌকায়। অন্যদিকে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতীকের জন্মই হয়েছে ইংরেজ বিরোধী এক মশাল মিছিল থেকে।
ক্লাব চালু হওয়ার সময় তাদের কোনো প্রতীক ছিল না। ১০ বছর পর ইংরেজ ফুটবল কর্তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানোর জন্য এক সন্ধ্যায় কর্তা ও সমর্থকেরা ময়দানের তাঁবু থেকে মিছিল করে আইএফএ অফিস পর্যন্ত গিয়েছিলেন। তখন তাঁদের হাতে ছিল জ্বলন্ত মশাল। সেটাই পরে অর্থবহ হয়ে দাঁড়ায়। যেন প্রতিবাদের প্রতীক। এই প্রতিবাদী চরিত্রটাই ইস্টবেঙ্গলের আসল শক্তি। (প্রথম আলো, ‘ঘটি-বাঙাল লড়াই থেকে জন্ম নেওয়া ক্লাবের ১০০ বছর’, রূপক সাহা, প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০১৯)
ইস্টবেঙ্গল ক্লাব প্রথম মাঠে নামে ১৯২০-র ১১ অগাস্ট, হারকিউলিস কাপে। ১৯২১ থেকে ক্লাব কলকাতা লিগের দ্বিতীয় ডিভিশনে খেলতে শুরু করে। চার বছর পর ১৯২৫ থেকে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব এলো প্রথম ডিভিশন লিগে। ১৯২৮-এ ঘটে অবনমন। তিনটি মরশুম দাঁতে দাঁত চেপে দ্বিতীয় ডিভিশনে লড়াই করার পর কিংবদন্তী সূর্য চক্রবর্তীর নেতৃত্বে ১৯৩১-এ আবার প্রথম ডিভিশনে ফিরে আসে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। সূর্য চক্রবর্তীর মতোই এই পর্বে ক্লাবের আরেক লড়াকু যোদ্ধা ছিলেন মণি তালুকদার, ১৯২০ থেকে ১৯৩৭ টানা আঠারো বছর তিনি ইস্টবেঙ্গলের গোলরক্ষক ছিলেন। এরপর ১৯৪২-এ প্রথম লিগ জয়ের মধ্য দিয়ে চারের দশক থেকে শুরু হয় ইস্টবেঙ্গলের জয়যাত্রা।
ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ইতিহাসে কর্মকর্তা হিসেবে অমর হয়ে আছেন প্রাণপুরুষ জ্যোতিষচন্দ্র গুহ। নিজে খেলতেন গোলকিপার হিসেবে, কাজেই আগলে রাখার সহজাত প্রহরী সুলভ ব্যক্তিত্ত্ব তাঁর ছিল। সেই সঙ্গেই তিনি ছিলেন প্রখর দূরদর্শী। দেশভাগের মধ্য দিয়ে যখন স্বাধীনতা আসছে সেইসময়েই তিনি আঁচ করেছিলেন আগের মতো আর অত সহজে পূর্ববঙ্গ থেকে প্লেয়ার আনানো যাবে না। কাজেই তিনি ভারতেরই অন্য রাজ্যগুলির দিকে নজর দিলেন, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতের দিকে।
দক্ষিণ ভারতীয় পাঁচ ফুটবলার—আপ্পা রাও, আমেদ খান, ভেঙ্কটেশ, সালে আর ধনরাজকে নিয়ে তৈরি হল ইস্টবেঙ্গলের সোনালি ‘পঞ্চপাণ্ডব’ ফরোয়ার্ড লাইন। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৩ সাল, ক্লাবের মোট ৩৮৭টি গোলের মধ্যে ২২৬ টা গোলই এসেছিল ওই পঞ্চপাণ্ডবের থেকে, এসেছিল একের পর এক ট্রফি। সময়টা খেয়াল করার মতো, উদ্বাস্তু স্রোতের আবহে উপচে পড়ছে হাওড়া আর শিয়ালদহ স্টেশন, অন্যদিকে ময়দান কাঁপাচ্ছে ‘ইস্টবেঙ্গল’। তখন কলকাতার ফুটবলে কোচের ধারণাই ছিল না। বরং কয়েককদম এগিয়ে জ্যোতিষবাবু একদিকে ক্লাবের প্রশাসক অন্যদিকে নিজের ফুটবল জ্ঞান কাজে লাগিয়ে কার্যত পালন করছেন বিদেশের ক্লাবগুলির মতো ম্যানেজারের ভূমিকা। এরপর ১৯৭০-এর প্রথম অর্ধে ছুটেছিল ইস্টবেঙ্গলের অশ্বমেধের ঘোড়া। কিংবদন্তী কোচ ‘ভোকাল টনিক স্পেশ্যালিস্ট’ পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তার সারথি, শতবর্ষের উদ্যাপন বছরেই আমরা হারিয়েছি তাঁকে। এই সময়েই ইস্টবেঙ্গল টানা ছ’বার কলকাতার লিগ জেতে, মোহনবাগানকে শিল্ডের খেলায় ৫-০ হারায়, কোনো গোল না খেয়ে লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়। এই অধ্যায় ইস্টবেঙ্গলের স্বর্ণযুগ।
১৯৭৭-এ আরেক অধ্যায়ের সূচনা, ক্লাবকর্তা হিসেবে আসেন আধুনিক ইস্টবেঙ্গলের রূপকার দীপক (পল্টু) দাস। ইস্টবেঙ্গলকে তিনি নিয়ে যান সাফল্যের তুঙ্গে। ১৯৯৯-এর প্রথম জাতীয় লিগ জয়, ২০০৩-এ আন্তর্জাতিক আসিয়ান কাপ জয়— শতবর্ষের উজ্জ্বলতায় উজ্জ্বল লাল-হলুদ মশালের আগুনগাথা এভাবেই ক্রমশ লেখা হয়ে চলেছে, চলবেও।
ডার্বির কথা
ইস্টবেঙ্গলের কথা হবে আর ডার্বির কথা হবে না তাই কখনও হয়? ডার্বি (Derby) শব্দটির উৎপত্তি ঘটেছে ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতা থেকে, তবে বর্তমানে বিভিন্ন খেলাতেই শব্দটি ব্যবহার হয়। বিশেষ করে ফুটবলের ক্ষেত্রে সেইসব ম্যাচই ডার্বির আখ্যা পায় যখন এমন দুই দল মুখোমুখি হয় যে দুটি দল একই স্থানীয় পরিসরে সম্পূর্ণ বিরোধী ও বিবাদী অবস্থানে রয়েছে। এই বিরোধ এবং বিবাদের ভিত্তি নিছক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের স্বার্থে হতে পারে, কিংবা হতে পারে আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক কারণে। বিশ্বের ফুটবল ইতিহাসে এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন ডার্বি। যেমন ব্রাজিলে ফ্ল্যামেঙ্গো বনাম ভাস্কো, আর্জেন্টিনায় বোকা জুনিয়র্স বনাম রিভারপ্লেট; ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার ডার্বি— ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বনাম ম্যানচেস্টার সিটি, স্পেনের মাদ্রিদ ডার্বি— রিয়েল মাদ্রিদ বনাম অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। ফুটবলের মক্কা কলকাতায় ঠিক তেমনই ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ডার্বি—এশিয়ার ফুটবলের সেরা আকর্ষণ, আন্তর্জাতিক ফুটবল ফেডারেশন FIFA-র বিচারে ‘Classical Football Derby’ তকমা পাওয়া এই প্রতিদ্বন্দ্বীতা “world’s most popular and enduring rivalries’।
কবে থেকে শুরু হল এই প্রতিদ্বন্দ্বীতা? ইতিহাস বলছে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবগান ডার্বির ইতিহাস এই ২০২০তে পা রাখল ৯৫ বছরে। ১৯২৫ সালের ২৮ মে খেলা হয়েছিল ইতিহাসের প্রথম কলকাতা ডার্বি। ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান। কলকাতা লিগের সেই ম্যাচে মোনা দত্তের অধিনায়কত্বে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানকে ১-০ গোল করে হারিয়ে দেয়। জয়সূচক গোলটি করে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন নেপাল চক্রবর্তী। তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত ভারতের এই দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের মধ্যে সাড়ে তিনশোরও বেশি ডার্বি ম্যাচ খেলা হয়েছে। যা অবশ্যই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে বলা চলে। ড্র ম্যাচ বাদ দিলে জয়ের পরিসংখ্যানের বিচারে ইস্টবেঙ্গল এগিয়ে রয়েছে।
শতবর্ষের আলোয় ডার্বির কথা বলতে গেলে কিছুতেই বাদ দেওয়া যাবে না ১৯৭৫-এর আই এফ এ শিল্ড ফাইনালের ডার্বির কথা। চিরস্মরণীয় এই ডার্বির ৫-০ স্কোরলাইন আজও ইস্টবেঙ্গলের অহংকার, ইস্টবেঙ্গল একটি পেনাল্টি মিস না করলে সেদিন হাফ ডজন গোলের মালা পরতে হত মোহনবাগানকে। সারা মাঠ দাপিয়ে সেদিন খেলেছিলেন ইস্টবেঙ্গলের সোনালি ছেলের দল— সুরজিত সেনগুপ্ত, শ্যাম থাপা, রঞ্জিত মুখোপাধ্যায় এবং শুভঙ্কর সান্যাল। শ্যাম থাপা করেছিলেন দুটি গোল, বাকিরা একটি করে। উত্তেজিত অপমানিত মোহনবাগান সমর্থকরা সেদিন মোহনবাগান তাঁবু ঘিরে বিক্ষোভ জানিয়েছিল, ইতিহাস সাক্ষী, কট্টর মোহনবাগান সমর্থক উমাকান্ত পালোধি সেদিন আত্মহত্যা করেছিলেন সুইসাইড নোটে এই কথা লিখে যে পরের জন্মে মোহনবাগানের প্লেয়ার হয়ে ফিরে এসে এই হারের বদলা নেবেন। ঐতিহাসিক এই ডার্বির পাশেই রাখা যায় ’৯৭-এর ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনালের ডার্বিকে। এই ডার্বি একদিকে বিখ্যাত হয়ে আছে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গণের ১ লক্ষ ২৫ হাজার দর্শক সমাগমের রেকর্ডে অন্যদিকে বিখ্যাত হয়ে আছে সাইডলাইনে দাঁড়ানো দুই কিংবদন্তী ফুটবল মস্তিষ্কের ট্যাকটিক্যাল লড়াইয়ের জন্য— মোহনবাগানের অমল দত্তের ডায়মন্ড সিস্টেম আর স্লেজিং আক্রমণের বিপরীতে পিকে ব্যনার্জির আগুনে ‘ভোকাল টনিক’… টানটান উত্তেজনা, লাল হলুদ জার্সি গায়ে যুবভারতীর মাঠে বাইচুং ভুটিয়া নামতেই মোহনবাগান গ্যালারি থেকে ‘চুং চুং’ স্লেজিং-এর জবাব সেদিন বাইচুং দিয়েছিলেন হ্যাট্রিক করে, ৪-১ স্কোরলাইনে শেষ হাসি হেসেছিলেন পিকে।
সোনালি এইসব মুহূর্তের পাশেই রয়েছে একটি কালো দিন, ১৯৮০-র ১৬ অগস্ট, কলকাতা ময়দানের কালো দিন। ইডেন গার্ডেনে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ দেখতে এসে সেদিন আর বাড়ি ফেরেনি ১৬টি তরতাজা প্রাণ৷ স্টেডিয়ামের ডি ব্লকে অতিরিক্ত দর্শক প্রবেশ করায় সেই ভিড় সামলাতে ব্যর্থ হয় পুলিশ৷ নিজেদের মধ্যে ধস্তাধস্তি করে প্রাণ হারান দুই দলের বিবাদী সমর্থকরা৷ সেই অমর ফুটবলপ্রেমীদের শ্রদ্ধা জানিয়ে মান্না দে গেয়েছিলেন বিখ্যাত একটি গান- ‘খেলা ফুটবল খেলা/খোকা খেলতে গেল/সেই সকালবেলা../ আর ফিরল না৷’ ডার্বি ঘিরে এই উত্তেজনা রেষারেষি স্টেডিয়ামের মধ্যে, বাইরে, ম্যাচের আগে পরে প্রায়ই আইন শৃঙ্খলার সমস্যা ডেকে আনত, দু’দলের সমর্থকদেরই আক্রমণ প্রতি আক্রমণে বহুবার ভেঙেছে শালীনতার প্রাচীর, ভদ্রতার ব্যারিকেড। ১৯৮০-র সেই কালো দিন কার্যত ফিরে এসেছিল ২০১২-র আই লিগ ডার্বিতে। পরপর তিনজন মোহনবাগান খেলোয়াড় প্রথমার্ধেই হলুদ কার্ড দেখার পরই গ্যালারি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল, এরপর মোহনবাগানের স্তম্ভ ওডাফা ওকোলি লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়ার পরই বাঁধ ভেঙে যায় গ্যালারির। মোহনবাগান গ্যালারি থেকে উড়ে আসা আধলা ইঁটের ঘায়ে মাথা ফাটে ইস্টবেঙ্গলের রহিম নবির, সমস্ত যুবভারতীর গ্যালারিতে তাণ্ডব শুরু হয়ে যায়, লাঠি চার্জ করেও পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ হয় পুলিশ। দ্বিতীয়ার্ধে মোহনবাগান মাঠে দল না-নামানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ইস্টবেঙ্গলকে সে ম্যাচে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল। ফুটবলের উদ্যাপনে এমন অনভিপ্রেত ঘটনার সাক্ষী তাই ডার্বি থেকেছে বহুবার। আজও ডার্বি মানে আলাদা একটা উত্তেজনা, সারা বছর ভারতীয় ফুটবল থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা আইপিএল ক্রিকেটমোদী দর্শকও মিস করেনা ইস্ট-মোহন ডার্বির পরম্পরাবাহিত স্বাদ নিতে, সত্তর কিংবা নব্বই-এর দিনগুলির মতো উত্তেজনা আজ হয়তো নেই আর, তবু আজও ইস্ট-মোহন ডার্বির স্বাদে বাঙালির রসনা বাজারে ইলিশ অথবা চিংড়ির ডুয়েল অব্যাহত। কেননা এই ডুয়েল বাঙালির আবেগের সঙ্গে জড়িত, আর কে না জানে বাঙালি চিরকালের ‘সেন্টিমেন্টাল ফুল’।
ফুটবলের কর্পোরেটাইজেশনের হাতে পরে মোহনবাগান এখন এটিকে-মোহনবাগান, আগামী দিনে হয়তো ইস্টবেঙ্গলও পা বাড়াবে সেই পথে, তার আগেই চিটফান্ড অর্থকেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া বা রাজনৈতিক পাকেচক্রে বিদ্ধস্ত হওয়া— শতাব্দীর ইস্টবেঙ্গল দেখেছে অনেক কিছুই, দেখেছে বাঙাল-বাঙালি আবেগে ভর করে জন্ম নেওয়া একটি ক্লাব থেকে ক্রমশ বাঙালি খেলোয়াড়দের সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার বৃত্তান্তও। তবু আজও, শতবর্ষ পেরিয়েও বাঙালির কাছে ইস্টবেঙ্গল একটি আবেগের নাম। যে নাম নিয়ে জন্মলগ্নেই প্রাদেশিকতার অভিযোগ উঠেছিল আজ তা ভৌগোলিক-রাজনৈতিকভাবে ঠিক কিনা এর উত্তর আমাদের জানা নেই, শোনা যায় দেশভাগের পর এই পূর্ববঙ্গীয় সত্তা পরিচয়কে জিইয়ে রাখতে চাননি পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। উদ্যত হয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গল আর মহামেডান ক্লাবের নাম বদলানোর জন্য; আঞ্চলিক ভেদাভেদ আর ধর্মীয় উসকানিকে প্রশ্রয় দেবেন না বলে। ক্লাবকর্তা জ্যোতিষচন্দ্র গুহ এর প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছিলেন। এমনকি গতবছর ক্লাবের শতবর্ষের সূচনা লগ্নেও পশ্চিমবঙ্গের একটি দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতা, অধুনা পূর্বাঞ্চলীয় এক রাজ্যের রাজ্যপালও ‘পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে ইস্টবেঙ্গল নামের অস্তিত্ব’ নিয়ে বিতর্কিত টুইট করেছিলেন, কিন্তু শতবর্ষ পেরিয়েও শত শত জ্যোতিষগুহ আজও বেঁচে আছে একথা বুঝতে তাঁর বেশি সময় লাগেনি, মাত্র আধ ঘণ্টাতেই তিনি বাধ্য হয়েছিলেন টুইটটি মুছে দিতে। কেননা:
“ইতিহাস সাক্ষী হল
পায়ে পায়ে স্বপ্ন এলো
কাঁটাতার টপকালো ফুটবল
রক্তে ছিল যে লাল
জ্বললো হলুদ মশাল
ফেলে আসা স্মৃতিটা সম্বল
জার্সি মানেই আমার মা
আর তো কিছুই জানি না
…
একশো বছর ধরে মাঠ কাঁপাচ্ছে যে দল
লাল হলুদের ঝড়ের নাম
ইস্টবেঙ্গল।”
কাজেই না থাকুক ভৌগোলিক পূর্ববঙ্গ, তবু কাঁটাতার পেরিয়ে আসা জনগণের অহং হয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবে ইস্টবেঙ্গল। ইতিহাসকে এতো সহজে মুছে ফেলা যায় না। ইস্টবেঙ্গল তাই চিরঅক্ষত এক স্পর্ধার নাম, নিছক একটা ক্লাব নয়, ইস্টবেঙ্গল একটি ইতিহাসের নাম। যাকে মুছে ফেলা অসম্ভব, অসম্ভব, অসম্ভব।
লেখকের কথা: এই লেখায় যে সমস্ত ঐতিহাসিক তথ্য বিবরণ উল্লেখিত হয়েছে সেগুলি যথাসম্ভব যাচাই করা হলেও কিছু ক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী তথ্য ও বিভ্রাট থাকায় অধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এরপরেও এই লেখায় যদি কোন তথ্যগত বা অন্য কোনওরকম বিভ্রাট বা ভুল থাকে তবে সুধী পাঠক তা ধরিয়ে দেবেন এই আশা রাখি। লেখাটি কেমন লাগল তা অবশ্যই কমেন্ট করে জানান।
~ সমস্ত উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে মূলের বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
ঋণ:
যেসব বইয়ের সহযোগিতা নিয়েছি:
১। ত্রিদিব চক্রবর্তী, নিরুপমা রায় মণ্ডল ও পৌলমী ঘোষাল (সম্পাদিত), ধ্বংস ও নির্মাণ বঙ্গীয় উদ্বাস্তু সমাজের স্বকথিত বিবরণ, প্রথম সংস্করণ, স্কুল অফ কালচারাল টেক্সট অ্যান্ড রেকর্ডস্, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও সেরিবান, কলকাতা।
২। অশ্রুকুমার সিকদার, ভাঙা বাংলা ও বাংলা সাহিত্য, কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, নভেম্বর ২০০৫।
৩। Urvashi Butalia, The Other Side of Silence, Penguin, 1998, page 357.
৪। মননকুমার মণ্ডল (সম্পাদিত), পার্টিশন সাহিত্য: দেশ-কাল-স্মৃতি, কলকাতা: গাঙচিল ও নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, সেপ্টেম্বর ২০১৪।
৫। সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেশভাগ-দেশত্যাগ, কলকাতা: অনুষ্টুপ, জানুয়ারি ২০১০।
৬। সেমন্তী ঘোষ (সম্পাদিত), দেশভাগ: স্মৃতি আর স্তব্ধতা, কলকাতা: গাঙচিল, অগস্ট ২০১১।
৭। রূপক সাহা, ইতিহাসে ইস্টবেঙ্গল, কলকাতা: দীপ প্রকাশন।
৮। শান্তিপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়, ক্লাবের নাম ইস্টবেঙ্গল।
৯। সুবোধচন্দ্র দত্ত চৌধুরী, ইস্টবেঙ্গল সোনার ইস্টবেঙ্গল, কলকাতা: মিলেনিয়াম কম্পিউটেক সেন্টার, প্রথম সংস্করণ, ২০০৫।
যেসব পত্রপত্রিকার সাহায্য নিয়েছি:
১। উত্তম পুরকাইত (সম্পাদিত), উজাগর পত্রিকা: পার্টিশন মানবাধিকার গণতন্ত্র ও সাহিত্য সংখ্যা, ত্রয়োদশ বর্ষ, প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা ১৪২৩, হাওড়া।
২। আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘শতবর্ষের শত মুক্তো’, স্পর্ধার শতবর্ষ, ৩০, জুলাই, ২০১৯।
৩। প্রথম আলো, ‘ঘটি-বাঙাল লড়াই থেকে জন্ম নেওয়া ক্লাবের ১০০ বছর’, রূপক সাহা, প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০১৯
যেসব আন্তর্জালিক সূত্র ব্যবহার করেছি:
https://bengali.indianexpress.com/sports/why-eastbengal-club-jersey-red-and-yellow-125714/
https://www.anandabazar.com/amp/sport/100-glorious-events-of-east-bengal-1.1025194
https://bengali.news18.com/videos/sports/football-east-bengal-name-history-ss-351152.html
https://www.fifa.com/news/india-all-consuming-rivalry-1414458
সানু ঘোষ
বাঁশদ্রোণী, কলকাতা














মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন