সময়, সৃষ্টি ও বিস্ময়ের এক ছোট্ট গল্প





১.

আমেরিকার অ্যারিজ়োনার এ এক ওয়র-মেমোরিয়াল।

এমনিতে যুদ্ধ এবং তার কোনো স্মারক নিয়ে বিশেষ আদিখ্যেতা আমার আসে না। তার-উপরে মার্কিনী যুদ্ধস্মারক নিয়ে, বুঝতেই পারছেন, আহ্লাদ করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু এই স্থাপত্যটি যিনি হাতেকলমে বানিয়েছেন সেই — রাষ্ট্র নয় — সেই শিল্পীমানুষটি এর ভিতরে বুনে দিতে পেরেছেন এক অদ্ভুত বিস্ময়, সেটা আমাকে টানে।
সেই বিস্ময়ের কথাটুকু আজ আপনাদের বলি।

তাঁর টাস্ক্‌ ছিল : এক নিশ্চল স্থাপত্যের মধ্যে দিয়ে একটা স্থির সময়কে ধরতে হবে। সময়টা হচ্ছে, নভেম্বর মাসের (১১তম মাস) ১১ তারিখের সকাল ১১টা বেজে ১১ মিনিট ১১ সেকেন্ড! হ্যাঁ, প্রতিবছরের এই অতিনির্দিষ্ট সময়টিকে ধরতে হবে এক স্থাপত্যের অচঞ্চলে। আমার বন্ধুদের মধ্যে যাঁরা শিল্পীমানুষ, তাঁরা ভাবুন দেখি, কীভাবে এটা করা সম্ভব! 
একটা ঘড়ি বানিয়ে আখাম্বা বসিয়ে রাখা যায় মাঝমাঠে, আমার মতো অরসিকের ভাবনার দৌড় ওই পর্যন্তই পৌঁছোয় বটে। কিন্তু একজন শিল্পী কী করবেন?


২.

পাঁচটা পরপর স্তম্ভ। 
তাদের গায়ে এক বিশেষ কৌণিক দূরত্বে পাঁচটা বড়ো গর্ত। স্তম্ভগুলির সামনে, মাটির উপরে, আঁকা আছে এক গোল চক্র। আর গোটা ব্যাপারটা এমন আশ্চর্য সুকৌশলে নির্মাণ করা হয়েছে যে, উপরে যে নির্দিষ্টতম সময়টা বললাম, প্রতি বছর ঠিক ওই মুহূর্তটিতেই ওই গর্তগুলো বেয়ে সূর্যালোক এসে ভরিয়ে দেবে ওই চক্র। যে মাপের চক্র, অবিকল ঠিক সেই মাপের গোল আলো। 

বলা বাহুল্য, ওই নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে এটা আর কখনই ঘটবে না। সময়টা যেই বদলে যাবে, আলোও সরে যাবে অন্যত্র!

(সময় বদলালে আলো আসার ধরনও বদলে যায়)




৩.

ভেবে দেখুন একবার, এই স্থাপত্যটা আসলে ঠিক কী উপকরণে বানানো হল তাহলে? ইঁট, বালি, রড, সিমেন্ট, রঙ, সেসব তো আছেই। আর কিছু আছে?

আছে।

এই স্থাপত্যের একটা উপকরণ, স্বয়ং সূর্য!  আর-একটা উপাদান, পৃথিবী। সূর্যের চারিদিকে যে নিরন্তর ঘুরে চলেছে একইভাবে, একই পথে। আর শেষতম উপাদান : সময়! 

আজকের মানুষেরা চলে যাবে একদিন। অন্য মানুষ আসবে। আজকের সভ্যতা একদিন মুছে যাবে। অন্য সভ্যতা আসবে। হয়তো পৃথিবীর সব যুদ্ধ একদিন থেমে যাবে। কিন্তু এই স্তম্ভ যতদিন দাঁড়িয়ে থাকবে, ততদিন, প্রতিবছর ওই একটি মুহূর্তে, আলো ওখানে এসে পৌঁছোবেই। এর কোনো ব্যতিক্রম নেই, কোনো অলঙ্ঘন নেই! 

রবীন্দ্রনাথ একটা কবিতায় লিখেছিলেন, 
হে ধরণী, কেন প্রতিদিন/ তৃপ্তিহীন/ একই লিপি পড়ো ফিরে ফিরে?
এক শিল্পী সেই তৃপ্তিহীন ধরণীকে যেন কয়েদ করলেন তাঁর সৃষ্টিতে। সুন্দর না, বলুন?


.

ছবিটা দেখতে দেখতে আজ আমার মনে হচ্ছিল, এই পৃথিবীর সন্তান আমরা, এক-একজন ৭০-৮০-১০০ বছরের জন্যে এ ধরণীর পিঠে চড়ে বেরিয়েছি এক অনিবার্য অভিযাত্রায়, জয়-রাইডে। বাধ্যত কখনও, একই লিপি তৃপ্তিহীন  নিরন্তর পড়ে যেতে হলে আমাদেরই কি একান্ত অধৈর্য হয়ে পড়লে চলে? 

একই ঘরে ঘুরে-ঘুরে আর একই মানুষের মুখ দেখে ক্লান্ত আর ক্লান্ত হতে থাকলে, এই সর্বংসহা ক্লান্তিহীন ধরিত্রীর থেকে সামর্থ্য জুটিয়ে নিন। 

দম রাখুন। খেলা ঘুরবে। 




জয়দীপ ঘোষ
____________________
২৪শে মার্চ, ২০২০, ইছাপুর

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মথ

শিক্ষক দিবস, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের নকল ও এক হতভাগ্য বাঙালি

চোদ্দ ভূতের আসরে