সত্যজিৎ রায় ও কমিকস




কমিকসের প্রতি সত্যজিৎ রায়ের যে বিপুল আগ্রহ ছিল তা আমরা জানি | সন্দীপ রায় ময়ূখ চৌধুরীকে নিয়ে লেখা আমার প্রসাদ কাকা (বিষয় কার্টুন, চৈত্র ১৪১৮) নামের এক স্মৃতিচারণে জানান, তার "বাবার সংগ্রহ করা বিদেশী কমিকসের" প্রচুর বই ছিল | ১৩৯১ বঙ্গাব্দের সন্দেশ-এ ছয় সংখ্যায় বেরিয়েছিল একটি বিদেশি কমিকস | বব দ্য মুর-এর সৃষ্ট ওই চরিত্রটিকে সত্যজিৎ রায় বানিয়েছেন নন্দখুড়ো | রেলওয়ে রিবলড্রি (১৯৩৫) নামের এক বইতে উইলিয়াম হিথ রবিনসনের প্রচুর কমিকস প্রকাশিত হয় | ১৩৮৭-৮৮ বঙ্গাব্দে রেলগাড়ির আদিপর্ব নাম দিয়ে এর কয়েকটি সন্দেশ-এ প্রকাশ করেন সত্যজিৎ, সঙ্গে অবশ্যই ছিল তাঁর লেখা ছড়া | সত্যজিৎ-সম্পাদিত সেরা সন্দেশ-এ স্থান পেয়েছে সেগুলি | ১৩৮৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যা থেকে সন্দেশ-এ প্রকাশিত হয় উইনসর ম্যাককের ড্রিম অফ রেয়ারবিট ফিল্ড-এর বঙ্গানুবাদ  দুঃসসসস্বপ্ন | এই অনুবাদ এবং লেটারিং দুই-ই সত্যজিতের  | কৌশিক মজুমদার তাঁর কমিকস ইতিবৃত্ত বইতে খুব সঠিকভাবেই মন্তব্য করেছেন ------- "'দুঃসসসস্বপ্ন' নামটির মধ্যেই এক অসাধারণত্ব আনেন তিনি | পরপর তিনটি 'স' যেন ফিসফিসিয়ে ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখার পর্যায়ক্ষমতাকে মূর্ত করে তোলে |" একটু লক্ষ করে দেখুন তো, ১৯৭৮-এ 'সন্দেশ'-এ উইনসর ম্যাককের কমিকস স্ট্রিপের ছবির প্রভাব, ১৯৭৯-এ জয় বাবা ফেলুনাথ সিনেমায় সত্যজিতের আঁকা করাল কুম্ভীর-এর প্রচ্ছদে খুঁজে পান কি না !






কমিকস যখন গল্প বলে (আজকাল, ২রা জুন ১৯৯৬) নামের এক লেখায় ময়ূখ চৌধুরী জানান ------ "কমিকস সম্পর্কে সত্যজিৎ রায়ের উৎসাহ ছিল দারুণ | তাঁরই সম্পাদনায় পরিচালিত 'সন্দেশ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল আমার প্রথম কমিকস ------- 'ঋণশোধ' (সম্ভবত বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক কমিকস) | ....... মানিকদার তত্ত্বাবধানে আরও কয়েকটি কমিকস আমি রচনা করেছিলাম এবং সেগুলো যথাসময়ে সন্দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল | তাঁর সক্রিয় সাহচর্য ও উপদেশ আমাকে যে কমিকস রচনায় যথেষ্ট সাহায্য করেছিল, সে কথা স্বীকার না করলে সত্যের অপলাপ ঘটবে |" ঋণশোধ বাদ দিলে, ১৩৭০-এর আশ্বিনে পেক্কা, ১৩৭৬-এর কার্তিকে সাক্ষী ছিল চাঁদ, ১৩৭৭-এর ভাদ্র-আশ্বিনে সিংহের শত্রু আর ১৩৭৯-এর কার্তিক-চৈত্রে প্রকাশিত মহাকালের মন্দির, সন্দেশ-এর সত্যজিৎ-যুগে ময়ূখের করা অবিস্মরণীয় চারটি চিত্রকাহিনি | ১৯৭০-এর মে-জুন সংখ্যায় সন্দেশ পত্রিকায় মুদ্রিত হয় শৈল চক্রবর্তীর ছেলে দীপকের করা কমিকস খুড়ো ভাইপো আর দুদাড়ি | ১৯৭০-এর জুলাই-আগস্ট, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, নভেম্বর-ডিসেম্বর আর ১৯৭১-এর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি, এই চারটি সংখ্যা জুড়ে সত্যজিৎ সন্দেশ-এর প্রচ্ছদ করেন স্বরচিত কমিকস দিয়ে | এক বাঙালিবাবুকে কেন্দ্র করে চারটে সংলাপহীন কমিকস স্ট্রিপ | ঋতুর সঙ্গে মিলিয়ে কীভাবে কমিকস এঁকেছেন সত্যজিৎ, তা রং তুলির সত্যজিৎ বইতে দেবাশীষ দেব আমাদের ধরিয়ে দেন ------- "প্রথমটা ছাপা হয় বর্ষা সংখ্যা অর্থাৎ জুলাই-আগস্ট মাসের সন্দেশ-এ -------- এখানে আসল মজাটাই ছিল তুমুল বৃষ্টি হয়ে এক কোমর জলের মধ্যে বাবুর আটকে পড়া | এর পরেই প্রকাশিত হয় শারদীয় সংখ্যা আর সত্যজিৎ এঁকেছিলেন চারদিকে বাজি ফাটানোর আওয়াজে বাবুর একেবারে কাহিল অবস্থা | তৃতীয়টি ছিল হেমন্ত সংখ্যা অর্থাৎ নভেম্বর আর ডিসেম্বর মাস ------ ছোটদের স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হবার সময় -------- তাই এখানে ছিল চিড়িয়াখানা যাবার ঘটনা | শেষ স্ট্রিপ-কার্টুনটা ছিল জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সংখ্যার প্রচ্ছদে | কলকাতায় এই সময় নিয়ম করে সার্কাসের দল আসে ------- কার্টুনের বাবুটিকেও দেখা গেল ভারত সার্কাসের একজন ট্রাপিজ-খেলোয়াড় হিসেবে |" সত্যজিৎ-সম্পাদিত  সন্দেশ-এ বিভিন্ন সময়ে নতুন শিল্পীরা যেসব কমিকস আঁকেন তাতেও রয়ে যায় সত্যজিতের ছোঁয়া | ১৩৮২-র ফাল্গুন থেকে ১৩৮৩-র কার্তিক এবং ১৩৮৩-র অগ্রহায়ণ থেকে ১৩৮৪-র আষাঢ় পর্যন্ত সন্দেশ-এ ইন্সপেকটর বিক্রমের দুটি অ্যাডভেঞ্চার কাহিনির কমিকস বের হয় | ছবি এঁকেছিলেন প্রতাপ মল্লিক আর কাহিনিকার ছিলেন আবিদ সুর্তি | মূল কাহিনি থেকে বাংলায় গল্পদুটির অনুবাদ করেছিলেন সত্যজিৎ রায় | সুবীর রায়ের কমিকস কিসসা সাজাহান কা-র নাম বদলে সত্যজিৎ করেন শাহজাহানের আজব কথা (১৩৮৫) | প্রশান্ত মুখোপাধ্যায় নলিনী দাশের গল্প অবলম্বনে ১৩৯১ বঙ্গাব্দে সন্দেশ-এ যে টোটোর অ্যাডভেঞ্চার নামের কমিকস আঁকেন, সন্দেশ কমিকস সমগ্র-এর সম্পাদকদের মতে ------"এই চিত্রকাহিনিতেও রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের হাতের অদৃশ্য ছোঁয়া |" নতুন চিত্রশিল্পীরা, যাঁরা কমিকস নিয়ে আগ্রহী ছিলেন, সত্যজিতের কাছ থেকে তাঁরাও উৎসাহ পেয়েছেন | তাহলে আমার বেড়ালটার কী হত? (কমিক্স ও গ্রাফিক্স, অক্টোবর ২০১৫) নামের এক লেখায় দেবাশীষ দেব জানান, কলেজের ফোর্থ ইয়ারে পড়বার সময় তার ইচ্ছা হয় কমিকস স্ট্রিপ করবার |  তিনি গল্প হিসাবে বেছে নেন সত্যজিৎ রায়ের ফটিকচাঁদ-কে | কমিকস সম্পূর্ণ হওয়ার পর, বন্ধু সুবীর রায় দেবাশীষকে নিয়ে যান, বিশপ লেফ্রয় রোডে, সত্যজিৎ রায়কে কমিকসটি দেখাবার জন্য ------- "সালটা মনে আছে ১৯৭৭-এর শেষের দিকে, কিন্তু তারিখটা ভুলে গেছি, ভুলে গেছি অনেক কিছুই, শুধু সত্যজিৎবাবু যে খুঁটিয়ে সবটা দেখেছিলেন আর সারাক্ষণ ওঁর চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম এটা মনে আছে | আমাকে উনি মোটেই নিরুৎসাহ করেননি, তবে ড্রয়িংটা আরো ভালো করে শিখতে হবে এই ধরনের কিছু একটা বলেছিলেন |" ঋতুপর্ণ বসুর সঙ্গে অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের এক কথোপকথনে জানতে পারি, এক সাক্ষাৎকারে সন্দীপ রায় বলেছিলেন "শঙ্কু ও ইউ.এফ.ও'র উপর করা অভিজিতের কমিকস সত্যজিৎ রায় দেখেছিলেন | এটাও অনেক আগের কথা, তবে দেখে তিনি খুশি হয়েছিলেন |"






কৈলাসে কেলেঙ্কারি-তে টিনটিন ইন টিবেট পাঠরত তোপসে জানায় -------- "আমার আর ফেলুদার দুজনেরই মতে রহস্য রোমাঞ্চ সাসপেন্স আর হাসিতে ভরা এর চেয়ে ভালো কমিক বই আর নেই |" এই মত, বলাই বাহুল্য স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের | সত্যজিতের সবচেয়ে পছন্দের কমিকস ছিল টিনটিন | দেবাশীষ দেব তাঁর রং তুলির সত্যজিৎ বইতে লিখেছেন ------ "সন্দীপ রায়ের কথায় ১৯৫০-এর দশকের শেষ দিকে এই টিনটিন সিরিজের একটা বই তিনি বিদেশ থেকে নিয়ে আসেন যা ছিল ফরাসি ভাষায় লেখা | পরে ১৯৬০ দশকের গোড়া থেকে এর ইংরেজি সংস্করণগুলোও ধীরে ধীরে সংগ্রহ করতে শুরু করেন সত্যজিৎ এবং বাবা-ছেলে দুজনে মিলে হয়ে ওঠেন এর নিয়মিত পাঠক |" সন্দীপ রায়ের দেওয়া তথ্য অনুসারে, বাড়িতে টিনটিনের বই আসলে, প্রথমে সত্যজিৎ পড়তেন, তারপর সন্দীপ ! সত্যজিতের অনুপ্রেরণাতেই নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী 'আনন্দমেলা'-র পাতায় টিনটিনের ধারাবাহিক অনুবাদ আরম্ভ করেন বলে শোনা যায় | লক্ষ করা যেতে পারে ১৯৭০-এর দশক থেকে সত্যজিৎ একাধিকবার তাঁর চলচ্চিত্রের শিশু-কিশোরদের হাতে তুলে দিয়েছেন টিনটিনের বিভিন্ন বই | ১৯৭৩-এ কৈলাসে কেলেঙ্কারি বইতে  আর ১৯৭৪-এ সোনার কেল্লা সিনেমায় তোপসেকে Tintin in Tibet পড়তে দেখি আমরা | ১৯৭৯-তে জয় বাবা ফেলুনাথ সিনেমায় কাশীতে হোটেলের ঘরে তোপসে পড়েছে The Broken Ear বইটি | সোনার কেল্লা-য় রাজস্থানের ট্রেনে তোপসের হাতে Land Of Black Gold  আর জয় বাবা ফেলুনাথ-এ রুকুদের বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে টিনটিনের The Black Island-ও চোখে পড়েছে দেবাশীষ দেবের!! 'শাখা প্রশাখা' চলচ্চিত্রের একেবারে অন্তিম লগ্নে প্রবীর এবং তপতীর ছেলে ডিঙ্গো দাদুর কাছে বলে ------ "ইয়েতি ! টিনটিন ইয়েতি দেখেছিল | মা আমাকে গল্প বলেছে |" আর 'আগন্তুক'-এর চিত্রনাট্যে (এক্ষণ, শারদীয় ১৪০০) সত্যজিৎ একবার লেখেন ------ "গাছের ছায়ায় বসে একটি বছর দশেকের ছেলে একটা টিনটিনের বই পড়ছে |" আর মনোমোহনের আসবার ঠিক আগের দৃশ্যে  লেখেন ------ "সদর দরজা খোলা | সেখানে টিনটিন হাতে বাবলু দাঁড়িয়ে আছে |" 'এহো হয় আগে কহ আর' | সোনার কেল্লা-য় টিনটিন-ব্যবহারের চমৎকার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন দেবাশীষ দেব ------- "এরপরে যোধপুরগামী ট্রেনে তোপসে পড়ছে Land Of Black Gold, ..... এই গল্পের প্রায় গোটাটাই মধ্যপ্রাচ্যের মরুশহরগুলিকে কেন্দ্র করে ------ সেখানে যোগ হয়েছে একজন আরব শেখ-এর ছ'বছরের ছেলে আবদুল্লাকে কিডন্যাপ করার ঘটনা | 'সোনার কেল্লা' সিনেমায় মুকুলের দুষ্টু লোকেদের খপ্পরে পড়া, যোধপুর, জয়সলমীর, মরুভূমির মাঝখানে ফেলুদা অ্যান্ড কোম্পানির ফেঁসে যাওয়া --------- টিনটিনের সঙ্গে এই মিলগুলো রয়েছে বলেই যে গোটা সিরিজের মধ্যে থেকে এই বইটাকে বেছে নিয়েছিলেন সত্যজিৎ সেটা বুঝতে কোনও অসুবিধে হয় না |" একইভাবে আমরা লক্ষ করতে পারি সত্যজিতের অন্যান্য কাহিনির সঙ্গে টিনটিনের কিছু আশ্চর্য মিল | Tintin in Tibet-এই ছিল কাঠমান্ডুগামী প্লেন ক্র্যাশ করার খবর ; আর কৈলাসে কেলেঙ্কারি-তে ওই "কাটমুন্ডুর প্লেন ক্র্যাশ" করেই মারা যান সিলভারস্টাইন ! জয় বাবা ফেলুনাথ সিনেমায় দেখা যায় The Broken Ear বইটিকে | প্রথমত, The Broken Ear-এর দুই ভিলেন ----- র‍্যামন আর অ্যালোনসো | একজন লম্বা, অন্যজন বেঁটে | বেঁটের মস্তিষ্ক প্রখর, লম্বাজনের হাত চলে বেশি | সোনার কেল্লা-র নকল হাজরা আর বর্মনের উপরে কি এদের ছাপ রয়ে যায়নি ? এই গল্পের ভিলেন র‍্যামন দুর্ধর্ষ এক ছোরাবাজ | এর থেকেই কি সত্যজিৎ জয় বাবা ফেলুনাথ উপন্যাসের মগনলালের সাগরেদ ছোরা-বিশারদ অর্জুনের কল্পনা করেছিলেন ? আর দ্বিতীয়ত, The Broken Ear-এ যে মূর্তিটিকে ঘিরে মূল সমস্যা ঘনীভূত হয়েছে, তার মধ্যে লুকানো ছিল একটি হিরে | জয় বাবা ফেলুনাথ-এর কাহিনির সঙ্গে কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে কি ? 





---------------------------------------------------------------
ঋণ : দেবাশীষ দেবের স্মৃতিকথা আমার গোচরে এনেছেন শ্রীমান শৌভিক মুখোপাধ্যায় |

________________________

নির্মাল্য কুমার ঘোষ
২৬.০৪.২০২০
________________________

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মথ

শিক্ষক দিবস, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের নকল ও এক হতভাগ্য বাঙালি

চোদ্দ ভূতের আসরে