পঁচিশ বছর আগের একদিন






‘কখন তোমার আসবে টেলিফোন’ সেই আশায় আশায় বসে থাকার দিন তো ফুরিয়ে গিয়েছে কবেই। পাবলিক টেলিফোনে মিটার বাড়ানো বেলা বোসের প্রেমিকদের দিনও আজ অস্তাগত। ঘুপচি কাঁচের ঘরের বাইরে রঙ ওঠা লেখায় ‘STD ISD PCO’-র নস্টালজিয়া আজ আর নেই। আর সেই ঘরের ভিতর কত মিনিটের কত হাসি কত দীর্ঘশ্বাস সব মিলিয়ে গিয়েছে হাওয়ায়, ফোন শেষে ক্যাচ ক্যাচ শব্দে একটা লম্বা কাগজের চলমানতা… ঘুড়ির লেজের মতো বেরিয়ে আসা বিল… এখন সবই ভোকাট্টা। সৌজন্যে মোবাইল ফোন… হাতে হাতে চলভাষ… দূর হয়েছে দূরভাষ।   

কিন্তু যন্ত্রটি যখন প্রথম ভারতে এসেছিল তখন কিন্তু তা এতো সহজলভ্য ছিল না। বরং ছিল বেশ দুর্মূল্য। ধনবান হওয়ার স্ট্যাটাস সিম্বল ছিল মোবাইল ফোন। খুব সাধারণ মানের একটা সাদাকালো ফোন, যাতে শুধু ফোনকল আর মেসেজ ছাড়া আর কিছুই করা যেত না, না ছিল ইন্টারনেট, না ছিল ক্যামেরা—তারও দাম ছিল প্রায় ২৫ হাজার টাকা। নিছক হাতে ধরে দেখানোর মতোই জিনিস ছিল সেটা!

 পরিসংখ্যান বলছে নয়ের দশকে এমনকি ২০০৫ পর্যন্ত সময়পর্বে প্রতি চল্লিশ জন ভারতীয়ের মধ্যে মোবাইল ফোন ছিল মাত্র একজনের। পাড়ায় একজনের মোবাইল ফোন আছে মানে, তিনি গোটা পাড়ার মধ্যে বিশেষ দ্রষ্টব্য। এক মিনিট কথা বলার জন্য সেই সময় কলচার্জ ছিল প্রায় ১৬ টাকা, এমনকি রোমিং-এর মতোই কল আসলেও কাটা হত চার্জ, মিনিটে ৮ টাকা, অর্থাৎ উভয়পক্ষ মিলিয়ে এক মিনিট মোবাইল ফোনে কথা বলার খরচ ছিল মোট ২৪ টাকা। আজকের ‘আনলিমিটেড প্যাকের’ যাপনের দিনে যা ভাবলেই হতবাক হয়ে যেতে হয়। 




    সেই দিন থেকে আজকের দিন, যখন প্রতি মাসে অন্তত একটি করে বা তারও বেশি নতুন মোবাইল ফোন লঞ্চ হয় ভারতের মার্কেটে, যখন বিশ্বের তাবৎ মোবাইল কোম্পানিগুলি তাঁদের ব্যবসার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে ভারতের বাজারের চাহিদার কথা মাথায় রেখে, যখন ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং সবচেয়ে দ্রুত বিকশিত হতে থাকা মোবাইল বাজার হিসেবে সমাদৃত হয়, যখন ভারত স্বপ্ন দেখে ‘ডিজিটাল ভারত’ হয়ে ওঠার, তখন এই আজকের দিনে, ৩১ জুলাই এলে মনে পরে পঁচিশ বছর আগের একটি দিনের কথা। সেই দিন, ৩১ জুলাই ১৯৯৫, ভারতের প্রথম মোবাইল ফোনকলের দিন, আজ সেই ঘটনার পঁচিশ বছর পূর্তি। 

    আজ থেকে ঠিক পঁচিশ বছর আগে, ১৯৯৫-এর ৩১ জুলাই কলকাতায় রাইটার্স বিল্ডিং থেকে দিল্লির সঞ্চার ভবনে ভারতের প্রথম মোবাইল ফোনকলটি করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী জ্যোতি বসু। ভারতের মধ্যে প্রথম নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থা গড়ে তুলে মোবাইল ব্যবহারের ইতিহাসে বিপ্লবভূমি হয়ে আছে আমাদের শহর কলকাতা। মোদী টেলস্ট্রারের চেয়ারম্যান বি. কে. মোদী-র উদ্যোগে নোকিয়া কোম্পানির সহযোগিতায় আজকের দিনেই ‘ভারতের প্রথম মোবাইল সিটি’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল কল্লোলিনী কলকাতা। যার মূল কাণ্ডারি ছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। আজকের ভারতের রাজনৈতিক সমীকরণে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র স্বপ্ন অন্য কেউ দেখাতেই পারেন, কিন্তু সময়ের থেকে এক কদম এগিয়ে থেকে শুরুটা করেছিলেন ভারতের জননেতা বামপন্থী জ্যোতি বসুই— একথা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকার না-করলে সত্যেরই অপলাপ হবে।   




ইতিহাসের সেই সূচনাটি হয়েছিল এক বছর আগে। সময়টা ১৯৯৪, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু একদিন রাইটার্স বিল্ডিং-এ ডেকে পাঠালেন বি কে মোদীকে। বি কে মোদী তখন মোদী টেলস্ট্রার চেয়ারম্যান। এই মোদী টেলস্ট্রারই পরবর্তী নাম হয় ‘স্পাইস’। জ্যোতি বসু মোদীকে বললেন, যে তাঁর একান্ত ইচ্ছে ভারতের প্রথম মোবাইল নেটওয়ার্ক সিটি হয়ে উঠুক কলকাতা। আর তার জন্য সবরকম প্রশাসনিক সাহায্য তিনি করবেন।

 বি কে মোদী প্রথমে একটু অরাজি হলেও শ্রী বসুর মুখের উপর না বলতে পারার সাহস করতে পারলেন না। শেষপর্যন্ত  রাজি হয়ে গেলেন, শুধু তাইই নয়, চ্যালেঞ্জ নিয়ে ঘোষণা করে দিলে একটি তারিখও, ৩১ জুলাই ১৯৯৫, এই দিনই কলকাতা হয়ে উঠবে ভারতের প্রথম মোবাইল নেটওয়ার্ক সিটি। 

রাইটার্সে সেই মিটিংটি হয়েছিল ’৯৪-র মাঝামাঝি সময়ে, মিটিং শেষ হওয়া মাত্রই মোদী টেলস্ট্রার কর্তারা চিন্তিত হয়ে পড়েন, কীভাবে এক বছরেরও কম সময়ে বাস্তবায়িত করা যাবে অমন স্বপ্ন। কথা রাখা যাবে কীভাবে?  

কিন্তু কথা দিয়ে কথা রাখার সম্মানের জেদ তখন পেয়ে বসেছে কর্তাদের, অতঃপর ছুটে গেলেন অস্ট্রেলিয়ায়, অপর অংশীদারদের সঙ্গে কথা বলতে। সেইসঙ্গে উপযুক্ত প্রযুক্তি নির্মাণের জন্য আগ্রহী সহযোগী কোম্পানির খোঁজে। বিশ্বের মোবাইল প্রযুক্তিতে তখন ‘নোকিয়া’ কোম্পানি  এক ঘুমন্ত দৈত্য, বি কে মোদী গাঁটছড়া বাঁধলেন তাদের সঙ্গে। যদিও এত কম সময়ে ভারতের মতো একটা দেশে কীভাবে মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি নির্মিত হবে তা নিয়ে ধন্ধে ছিল নোকিয়াও। 

কিন্তু ইতিহাসে অংশীদার হতে শেষপর্যন্ত তারাও গ্রহণ করল চ্যালেঞ্চ। মাত্র নয় মাসে গড়ে উঠল সম্পূর্ণ ব্যবস্থা। বি কে মোদী কথা রাখতে পারলেন, ১৯৯৫-র ৩১ জুলাই রাইটার্স বিল্ডিং-এ বসে জ্যোতি বসু ভারতের প্রথম মোবাইল কলটি করলেন তৎকালীন ইউনিয়ান কমিউনিকেশন মিনিস্টার সুখ রামকে, দিল্লির সঞ্চার ভবনে। কলকাতা থেকে বার্তা পৌঁছল দিল্লিতে। ভারতের মাটিতে সূচিত হল এক নতুন ইতিহাস। ঐতিহাসিক সেই ফোনকলের জন্য ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটির নির্মাতা ছিল নোকিয়া কোম্পানি। কার্যত সেই তখন থেকেই ভারতের মোবাইল ফোনের বাজারে নোকিয়া অবিসংবাদী এবং অচ্ছেদ্য হয়ে পড়ে। একসময়ে ভারতের মোবাইল ফোনের বাজারে ‘নোকিয়া’ ছিল কার্যত বিকল্পহীন, একচেটিয়া। 




 ভারতের বাজারকে মাথায় রেখেই নোকিয়া কম দামে ভালো গুণমানের ফোন আনায় নজর দেয় ১৯৯৮ থেকেই। এই বছরেই প্রথম ভারতীয় রিংটোন ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা’ স্থান পায় Nokia 5110 ফোনটিতে। এর বছর দুই বাদে, ২০০০ সালে লঞ্চ হওয়া Nokia 3210 ছিল প্রথম ভারতীয় ভাষায় (হিন্দি) মেনু সংযুক্ত মোবাইল ফোন। ভারতের প্রথম ক্যামেরা মোবাইল ফোনও এনেছিল নোকিয়াই, মডেল নম্বর Nokia 7650। ভারতের নাগরিকদের কথা মাথায় রেখে ঘোষিত ‘made for india’ নামক একটি পৃথক ব্র্যান্ডও তৈরি করেছিল নোকিয়া। এই ব্র্যান্ডের প্রথম লঞ্চ ছিল Nokia 1100, তুমুল জনপ্রিয় হওয়া এই  হ্যান্ডসেটটি একসময়ে কোটি কোটি ভারতীয়ের হাতে ঘুরত। 

    নোকিয়া ছাড়াও একসময় ভারতসহ সমগ্র বিশ্বের মোবাইল ফোনের বাজারে আধিপত্য ছিল মোটোরোলা কোম্পানির। প্রকৃতপক্ষে মোটোরোলাই ছিল বিশ্বের প্রথম মোবাইল ফোনের উদ্ভাবক তথা নির্মাতা। এই কোম্পানির সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার মার্টিন কুপার-ই হলেন মোবাইল ফোনের আবিষ্কারক। ১৯৭০ থেকে তিনি এই আবিষ্কারের চেষ্টা করে শেষপর্যন্ত সফল হন ১৯৭৩-এর ৩ এপ্রিল।  এই দিনই করা হয়েছিল বিশ্বের প্রথম মোবাইল ফোনকল। ফোনটি করেছিলেন আবিষ্কারক মার্টিন কুপার, মোটোরোলার রাইভ্যাল কোম্পানিকে তিনি এই ফোনকলের মধ্যে দিয়েই জানিয়েছিলেন, যে বিশ্বের ইতিহাসে মোটোরলাই যুগান্তকারী এই সৃষ্টিটি করল। কুপারের ব্যবহৃত সেই প্রথম মোবাইল ফোনটিকে কিন্তু আজ একঝলক দেখলে মনে হবে বুঝি এটি কডলেস টেলিফোন। কিন্তু না,  প্রায় ১.১ কেজি ওজন বিশিষ্ট এবং ২২৮.৬ X ১২৭ X ৪৪.৪ মি.মি. আয়তনের এই ‘জাম্বো সাইজ’ ফোনটি একটি মোবাইল ফোনই ছিল। যেটায় মাত্র কুড়ি মিনিট কথা বলা যেত এবং তার জন্য ফোনটিকে প্রায় দশ ঘণ্টা চার্জ দিতে হত।  

    এরও প্রায় দশ বছর পর ১৯৮৩-তে মোটোরোলাই গোটা বিশ্বে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে মোবাইল উৎপাদন শুরু করে। বাজারে আসতে থাকে একের পর এক হ্যান্ডসেট। দুর্মূল্য সেইসব প্রাগৈতিহাসিক মোবাইল ফোনের বিষয়ে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে রয়েছে নানা তথ্য। কিন্তু মোটের উপর বলা চলে সেইসব মোবাইল ফোন একেবারেই ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। আমাদের মতো দরিদ্র দেশে মোবাইল ফোনকে সর্বসাধারণের নাগালের মধ্যে এনেছিল নোকিয়া কোম্পানিই। আজকের স্মার্টফোন জমানায় প্রতিযোগিতার টানাপোড়েনে নোকিয়া চলে গিয়েছে ব্যাকফুটে, ভারতের মোবাইল ফোন মার্কেটে এখন স্যামসং, শাওমি-রই রমরমা।  



    সাম্প্রতিক চিন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনায় চিনা কোম্পানির মোবাইল-বাজার নিয়ে কিছু সংশয় তৈরি হয়েছে, এর ফলে হয়তো আগামীতে ভারতের মোবাইল বাণিজ্য কিছুটা হলেও বদলে যাবে। কিন্তু একটা কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যাপনে ক্রমশ ডিজিটাল ভারত হয়ে ওঠার পথে আজকের ভারতের পথ চলার প্রথম পদক্ষেপ কিন্তু ঘটেছিল এই কলকাতা শহরে, আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে। অন্য অনেক গর্বের প্রথমের মতোই কলকাতা এই বিষয়েও প্রথম, সৌজন্যে শ্রী জ্যোতি বসু, বি কে মোদী এবং নোকিয়া কোম্পানি। আপনার মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে ফুটে ওঠা এই লেখাটির মধ্যে দিয়ে তাই আসুন আমরা একযোগে ধন্যবাদ জানাই সেদিনের সেই কাণ্ডারিদের, যারা সময়ের থেকে কয়েক-কদম এগিয়ে চ্যালেঞ্চ নিয়েছিলেন বলেই আজ আমরা হাতের মুঠোয় ধরতে পারছি পৃথিবী, জানতে পারছি ব্রহ্মাণ্ডসংবাদ। 






ঋণ: 

  • https://youtu.be/3B5Oyd1IqEM  -- জ্যোতি বসুর করা প্রথম মোবাইল ফোনকলের মুহূর্তের ভিডিওটি। 

  • https://youtu.be/axx56_7Vz6Q  -- প্রথম মোবাইল ফোন নির্মাণ নিয়ে মার্টিন কুপারের স্মৃতিচারণা। 


সানু ঘোষ,

বাঁশদ্রোণী, কলকাতা



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চোদ্দ ভূতের আসরে

পার্টিশনের জীবনভাষ্য: প্রজন্মান্তরের খোঁজ

বুদ্ধের পুতাস্থি: রাখা রয়েছে কলকাতাতেই