আমার শহর ইয়ার শ্যাম

[মান্টোর স্মৃতিচারণ এগোতে থাকে, অভিনেতা শ্যামের সঙ্গে বন্ধুত্বের পরতগুলো উঠে আসে তাঁর লেখায়। নানা কথাপ্রসঙ্গের পর একটা শব্দে এসে থামেন মান্টো, হিপটুললহা। তারপর...]

পর্ব ২


যেভাবেই হোক ‘হিপটুললহা’ শব্দখানা একটা মানে জানাতে পেরেছে যে আমি বলতে চাইছি যে দৃশ্যের মধ্যে বর্ণনা বেশি হয়ে গেছে, ফলে দৃশ্যের জোর কমে গেছে।

মিটিং এ এর পরে, হসরত উপস্থিত ছিল, তার ওই দৃশ্যে বেশ কিছু ক্রিয়াকলাপ করতে হবে। আমাকে যখন আমার মতামত জানতে চাওয়া হল, আমি আবার বললাম, এইবারে একেবারে সচেতন হয়েই বললাম, ‘হসরত, দোস্ত, এইভাবে চাল খেললে হবেনা। অন্যকিছু করো যেটা বেশ ‘হিপটুললহা’ মানে ‘হিপটুললহা’ গোছের কিছু একটা করো দোস্ত’।

যখন আমি দ্বিতীয় বার বেশ জোর দিয়ে ‘হিপটুললহা’ শব্দটা বললাম, আমি চারিদিকে সবার প্রতিক্রিয়া দেখছিলাম, এবং দেখে বেশ উপভোগ করলাম যে শব্দটা সবাই বেশ গ্রহণ করেছে। এবং বাকি মিটিং জুড়ে সবাই এই শব্দটাকে নানাভাবে ব্যবহার করতে লাগলো, যেমনঃ ‘এই জিনিসের কোনও ‘হিপটুললহিটি’ নেই, অথবা ‘এটাকে আরও  ‘হিপটুললহাজাইসড’ করতে হবে। একটা সময়ে অশোক আমাকে বেশ চেপে ধরে বলল ‘এই মান্টো এই ‘হিপটুললহা’ শব্দের মানে কি হে! কোন ভাষার শব্দ এটি উৎস কি!’



অভিনেতা অশোককুমার

ততক্ষণে আমাদের সঙ্গে শ্যাম যোগ দিয়েছে। সে চোখ কুঁচকে বেদম হাসতে লাগলো। কারণ ট্রেনে খবরের কাগজে ওই অদ্ভুত অজ্ঞাত শব্দটা যখন দেখেছিলাম ও আমার সঙ্গেই ছিল। সে প্রায় হাসিতে গড়িয়ে পড়ে ঘরের সমস্ত মানুষজনকে জানান দিলো, এইসব একদম বকওয়াস, এ আসলে মান্টোর নতুন মান্টোইজম; যখন সবাই অর্থ উদ্ধারে ব্যর্থ হল, সে ‘হিপটুললহা’ শব্দটা বোম্বের ফিল্ম মহলে বেশ টেনে এনে চালু করে দিলো। আর শব্দটা এতোই জনপ্রিয় হয়ে উঠলো যে যে কেউ অদ্ভুত থেকে অতি নগণ্য যে কোনও অভিব্যাক্তি বোঝাতেই এই শব্দটা ব্যবহার করতো।



শ্যাম অভিনীত একটি ছবির পোস্টার

ঊনত্রিশে জুলাই, ১৯৪৮ এর একটি চিঠিতে শ্যাম লিখেছিলঃ

ব্রাদার মান্টো,

তুমি আবার তোমার স্বভাবসিদ্ধ নীরবতা অবলম্বন করেছ, আর তাতে আমি যৎপরনাস্তি বিরক্ত, যদিও আমি তোমার মানসিক অলসতা সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। যাকগে আমি যথেষ্ট ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছি—আর তাতে আমার কিছু করণীয় নেই—যখনই তুমি তোমার নীরবতার মধ্যে এইভাবে ঢুকে পড় তখনই আমার এমনই হাল হয়। যদিও এটা বেশ সত্যি কথা যে আমি নিজেকে চিঠির খুব ভালো কারবারি বলে দাবী করতে পারিনা; তবুও একটু অন্য ধরণের চিঠি লিখতে এবং পেতে আমার বেশ খানিক রোমাঞ্চ বা পুলক ঘটে, যাকে এক কথায়, ‘হিপটুললহা’ বলা চলে।

কিন্তু এখানে ‘হিপটুললহা’ কোনও এক বিলুপ্তপ্রায়\ অতীব দুষ্প্রাপ্য পাখি। যদি তুমি একটা কাগজ আঁকড়ে সেখানে লিখতে শুরু করো সেটা ‘হিপটুললহি’ হয়ে ওঠে, এবং কেউই তাকে ছুঁতে পারেনা, তুমি কল্পনা করতে পারো ব্যাপারটা কি চূড়ান্ত বিরক্তির হতে পারে। আমি যদি তোমাকে ‘হিপটুললাইজিং’ করে থাকি আমাকে মাফ কোরো, কিন্তু এছাড়া আমার কিই বা করণীয়? যখন যা সত্যি এবং বাস্তব সেটা যখন হারিয়ে যায়, একজন তখন ক্রমশ ‘হিপটুললেট’ হয়ে ওঠে, কিন্তু তুমি এইসব বিষয়ে কি ভাবো আর কি ভাবো না আমার তাতে সত্যিই কিছু এসে যায় না। সকলেই জানে যে তুমি এই বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল—যে আমিই একমাত্র সেই মানুষটি যার সেই সম্মান বা অধিকার রয়েছে তোমাকে দু চারটে ত্যাড়াব্যাকা কথা বলে একটু জব্দ করার তোমার সঙ্গে কষে ঝগড়া ফাঁদার কারণ তুমি যথেষ্ট ‘হিপটুললহা’।

মান্টো, জানো কেউ একজন বলেছিলেন, প্রেমিকদের অনেক সময় অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্য শব্দ কম পড়ে, যখন শব্দ ফুরিয়ে আসে, সে চুমু খেতে যায়; আর যখন কোনও বক্তার শব্দ কমে আসে, সে গলা খাঁকরি দিতে থাকে বা কাশে। আমি এই কাহাবতে একটু বাড়তি কথা যোগ করতে চাই। যখন একজন পুরুষের পৌরুষের উন্মত্ততা কমে আসে, সে তখন তার অতীতগামী হয়ে ওঠে। কিন্তু এইসব নিয়ে তুমি একেবারেই চিন্তিত হোয়ো না, আমি এখনও অন্তিম বিন্দুর থেকে বেশ খানিক দূরত্বে রয়েছি। জীবন এখনও যথেষ্ট পূর্ণ এবং যথেষ্ট বেগে ধাবমান, সামনের কোনও অজানা গন্তব্যে। আমি খুবই স্বল্প সময় পাই, সেই উন্মত্ততার সন্ধানে, এবং উদযাপনে, যদিও আমি বহুবাসনায় চাই, আরও গভীরতর ভাবে চাই।

নাসিমের সঙ্গে সেই ছবিটা (চাঁদনী রাত) অর্ধসমাপ্ত প্রায়, যদিও আমি আরও একটি চুক্তিতে সই করেছি অমরনাথের একটি ছবিতে। আন্দাজ করতে পারো সেই ছবিতে কে আমার নায়িকা হবে? নিগার, আমিই তার নাম প্রস্তাব করেছি, শুধুমাত্র এইটা খুঁজে দেখা এবং বোঝার জন্য যে এককালে আমাদের মধ্যে বাস্তব জীবনে যে টান যে উন্মাদনা ছিল, সেটা যদি পর্দায় ফুটিয়ে তোলা যায়, আরও একবার যদি সেইসব স্বর্নিল অবসর জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমাদের যে দিন গেছে সেকি একেবারেই গেছে! এককালে সেসব ছিল তো অত্যন্ত আনন্দঘন সব মুহূর্তরাজী, কিন্তু এইবার কাজের মধ্যে কি হৃদয়ের টান পাওয়া যাবে! তোমার কি মনে হয় ব্রাদার? গোটা ব্যাপারটা একটা উচ্ছল অনাবিল আনন্দলোক হয়ে উঠতে পারেনা?

তাজী এখনও আমার জীবনে যথেষ্ট উপস্থিত আর নিগার ও আমার প্রতি যথেষ্ট অনুভূতিশীল। সে আমাকে অত্যন্ত কদর যত্ন করে। কিছুদিন আগেই রামোলা বোম্বে এসেছিল, আমি ওর সঙ্গে দেখা করেছিলাম, এবং আবিষ্কার করলাম কি জানো! এককালে আমার প্রতি ওর যে নিদারুণ চিত্তদৌর্বল্য ছিল সেটা থেকে এখনও সে নিজেকে একটুও মুক্ত করতে পারেনি। অতয়েব আমাদের একসাথে নিদারুণ ভালো সময়, আনন্দ খেলা কলরোলে কেটেছে।

প্রাচীন বিরাদার আমার, ইদানীং আমি প্রেমের ভণিতার অতিরিক্ত মাত্রায় উন্নত তালিম পেয়েছি, কিন্তু কি জানো দোস্ত, এই গোটা ব্যাপারটা অত্যন্ত/ বিষম ভজঘট হয়ে উঠেছে, আর তুমি তো জানোই, আমি যে কোনও জটিল জিনিস বড্ড ভালোবাসি।

আমার মধ্যেকার ভ্রমণেচ্ছু, হঠকারী মানুষটা যথেষ্ট শক্তিশালী রয়েছে। আমি কোনও বিশেষ জায়গায় বাঁধা পড়ার মানুষ নই, আর আমি বাঁধা পড়তে চাই ও না। আমি মানুষদের যথেষ্ট ভালোবাসি, আবার আমি মানুষজনকে নিদারুণ ঘৃণা করি, এইভাবে জীবন যায়, এমনি করে যায় যদি দিন যাক না। মাঝেমধ্যে ভাবতে বসলে মনে হয়, জীবনই আমার একমাত্র পেয়ারী। যদি তুমি লোকজনের কথা বলো তারা সব দল বেঁধে জাহান্নামে যাক।

আমি লেখকের নামটি বেমালুম ভুলে গেছি কিন্তু আমার লাইনটি খানিক মনে আছে—হয়তো পুরোটা ঠিক নয়—তবে মোটামুটি তার বক্তব্য ছিল এরকম যে, ‘সে এতো মানুষ ভালোবাসত, এতো সঙ্গ এবং সঙ্গকাতরতা ছিল তার কখনও সে নিজেকে নিসঙ্গ মনে করেনি; কিন্তু যখন সে তাদেরকে ঘৃণা করতে শুরু করল্‌ সে নিজেকে চূড়ান্ত নিসঙ্গরূপে আবিষ্কার করলো।’ আমি এই লাইনে নিজের বিশেষ টিপ্পনী যোগ করলাম না।


চলবে...


সুশোভন প্রামাণিক

___________________

২২|০৭|২০২০

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চোদ্দ ভূতের আসরে

পার্টিশনের জীবনভাষ্য: প্রজন্মান্তরের খোঁজ

বুদ্ধের পুতাস্থি: রাখা রয়েছে কলকাতাতেই