আমার শহর ইয়ার শ্যাম
[সাদাত হাসান মান্টো (سعادت حسن منٹو), পরিচিত এবং বিতর্কিতও খানিক। আজও তাঁকে নিয়ে তৈরি হওয়া সিনেমা বিভিন্ন হলে মুক্তি পায় না, বাণিজ্যিক সফলতা তো দূরস্থ। বারবার বিভিন্ন লেখার জন্য তাঁকে পড়তে হয়েছে অশ্লীলতার দায়ে। পার্টিশনের অনিবার্যতায় ছিন্নমূল এই মানুষটি আমরণ বম্বের স্মৃতিকে ভুলতে পারেননি। মান্টোর এক অভিন্ন-হৃদয় বন্ধু ছিলেন অভিনেতা সুন্দর শ্যাম চাড্ডা। বম্বে টকিজের সেই সোনালি দিনগুলো কেমন ছিল? শ্যামের মৃত্যুর খবর মান্টোকে অবসাদগ্রস্ত করে, তার লেখায় উঠে আসে চলচ্চিত্র জগতের নানান কিসিমের স্মৃতিচারণ। সেই রঙিন স্মৃতি নিয়েই আজ থেকে শুরু হল ব্লগের নতুন ধারাবাহিক, 'আমার শহর ইয়ার শ্যাম'। আজ তার প্রথম কিস্তি...]
পর্ব ১
তারিখটা ছিল তেইশ কিংবা চব্বিশে এপ্রিল। আমার ঠিক মনে নেই। আমি লাহোরের এক মানসিক হাসপাতালে, বিস্মৃতির কামরা থেকে স্মৃতিগুলোকে স্থিতধি করছিলাম, সেখানেই এক সংবাদপত্রের পাতায় আমি প্রথম খবরটা পড়ি, শ্যাম আর নেই। আমি তখন এক অদ্ভুত অবস্থায় চলে গেছিলাম, সচেতন আর সম্পূর্ণ অচেতন এই দুই অবস্থার মধ্যে একেবারে নিলম্বিত হয়ে রয়ে গেছিলাম। এটা স্থির নির্ণয় করাও যথেষ্ট কঠিন হয়ে পড়েছিল যে কোথা থেকে কীসের শুরু। এই দুই অবস্থা এমন করে বিজড়িত হয়ে ছিল যে অত্যন্ত কঠিন ছিল তাদের কষে বের করা। আমার অনুভূত হচ্ছিল যেন আমি ‘নো ম্যান্স ল্যান্ডে’ দাঁড়িয়ে, চারদিকে শুধুই ধূ-ধূ প্রান্তর।
যখন আমার চোখে শ্যামের মৃত্যুসম্পর্কিত খবরটি পড়েছিল, আমি ভেবেছিলাম, আমি মদ্যপান ছেড়ে দিয়েছি বলে হয়তো এমনতর আজব ঘটনাবলী ঘটছে। এইতো গত সপ্তাহতেই, আমার পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য আমার অর্ধচেতনায় মরে হেজে গেল; পরে আমি জানলাম যে তাঁরা সবাই দিব্যি বেঁচে বর্তে আছেন, করে কম্মে খাচ্ছেন, এবং আমার দ্রুত আরোগ্যের জন্য প্রাণপণ প্রার্থনা করছেন।
আমার অতিস্পষ্ট করে মনে আছে কখন আমি শ্যামের মৃত্যু সংবাদ পড়েছিলাম, আমি আমার ঘরের অন্য এক নিবাসীকে বলি, ‘আমার খুব প্রিয় এক বন্ধু মারা গেছে, তুমি কি সে বিষয়ে কিছু জানো?’
সে প্রশ্ন করলো, ‘কে?’।
আমি অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললাম, ‘শ্যাম’।
‘কোথায় ? এই ক্ষ্যাপাদের আস্তানায়?’
আমি তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। হঠাৎই, একের পর এক হরেক কিসিমের ছবি আমার এই নিরতিশয় উত্তেজিত মগজে ভেসে উঠতে থাকে, যা আমার জীবনজুড়ে সঞ্চয় করেছিলামঃ শ্যামের মৃদু হাসিমুখ, শ্যাম উচ্চস্বরে হাসছে, শ্যাম চিৎকার করছে, জীবনীশক্তিতে পরিপূর্ণ শ্যাম, আমার বন্ধুবর যে নিতান্তই মৃত্যুর আতঙ্ক থেকে অনবহিত। আমি যেন আমার নিজেকে বোঝালাম যে খবরের কাগজে যা পড়েছি, সেসব একেবারে পরবাস্তব এবং মিথ্যে। এমনকি এই যে খবরের কাগজ, একে যে আমি হাতে ধরে রয়েছি এইসব আমার অলীক-কল্পনা।
কিন্তু যেমন ভাবেই সময় পেরোতে লাগলো আমার মনের মধ্যে থেকে কোহলের কুয়াশা ক্রমে সরে যেতে লাগলো, আমি বাস্তবের পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হলাম। গোটা প্রক্রিয়াটিই এতো মৃদু ধীর যে যখন আমি সত্যিই অনুভূত করলাম যে শ্যাম মারা গেছে, আমি কোনও অভিঘাত উপলব্ধি করিনি। আমার অনুভূত হল যেন বহু বহুদিন আগে তার মৃত্যু হয়েছে, আমি সেই অতীতেই তার এই চলে যাওয়া নিয়ে শোকপালন করেছি, শুধুমাত্র দুঃখের যেসব লক্ষণ সেগুলো এখন আমার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে, এক ধ্বংসাবশেষ যার মধ্যে থেকে আমি খুঁড়ে চলেছি এই আশায় সেখানের ভাঙাচোরা পিণ্ড বস্তু ইট আর পাথুরে স্তূপ সরিয়ে, আমি হয়তো কোথাও খুঁজে পাবো প্রোথিত হাসিখানি যা একসময় শ্যামের ছিল, অথবা তার সেই হাসির মধ্যে থাকা প্রাণবন্ততার খানিক নিনাদটুকু।
পাগলাগারদের বাইরে বিবেকী প্রকিতস্থ দুনিয়ায়, এটা বিশ্বাস করা হত মান্টো শ্যামের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে পাগল হয়ে গেছিল। হয়তো সেরকমই কিছু ঘটেছিল, আমি অত্যন্ত দুঃখে কাতর হয়ে পড়েছিলাম, কারণ শ্যামের মৃত্যু আমাকে আক্কেলমন্ত তৈরি করেছিল, দুনিয়ার অনিত্যতা সম্পর্কে আমার অবগতিকে অগ্রসর করেছিল।
শ্যামের মৃত্যুসংবাদ শুনে পাগল হয়ে যাওয়া আদতেই উন্মত্ততা।
গালিব লিখেছিলেন, উপকথাখ্যাত প্রেমিক ফারহাদকে যখন তার প্রেমিকা শিরিন’-এর মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছিলো, সেই মুহূর্তেই, সে তার নিজেকে যন্ত্রের একটি ঘায়ে খতম করে দিয়েছিল যে যন্ত্র দিয়ে সে পাথর খোদাই এবং ভাঙার কাজ করছিল। গালিব এইরকম কার্যকলাপকে এক মহান প্রেমিকের জন্য খুব একটা যোগ্য বা মূল্যবান মনে করেননি। সে তার নিজের জীবন বিসর্জন দেওয়ার জন্য এরকম গতানুগতিক এবং যান্ত্রিক পদ্ধত্তি কেন অবলম্বন করবে? তাকে নিবৃত্ত করা উচিৎ ছিল। আমিই বা কি করে শ্যামকে অপমান করি, শ্যাম যে কোনও দস্তুরমাফিক জিনিস চূড়ান্ত অপছন্দ করতো, আমি পাগল হয়েছি এ এমন কি ক্ষতিকর ?
শ্যাম দিব্যি বেঁচে আছে। শ্যাম বেঁচে আছে তার দুই সন্তানের মধ্যে যারা তাজীর প্রতি তার অত্যুজ্জ্বল ভালোবাসার নিদর্শন, যাকে সে প্রায়ই ‘আমার দুর্বলতা’ বলে ডাকতো। সে সেই সমস্ত নারীর মধ্যে বেঁচে আছে যাঁদের সিল্ক এবং মসলিন এর উত্তরীয়গুলির আতত তার ভালোবাসার হৃদয় অনুরঞ্জিত করতো। সে আমার হৃদয়ে জলজ্যান্ত রয়েছে, যা ব্যাথায় গুমরে মরছে এই কারণে যখন সে মৃত্যুশয্যায় আমি তখন তার পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে পারিনি, ‘শ্যাম জিন্দাবাদ’।
আমি নিশ্চিত সে পরম ঋজুতায় মৃত্যুর চুম্বন গ্রহণ করেছে, তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে হয়তো বলেছে, ‘মান্টো ভগবানের দিব্যি গেলে বলছি, ওই অধরোষ্ঠ অন্যকিছু ভাই’।
যখন আমি শ্যামের কথা ভাবি, আমার তখন রাশিয়ান লেখক মিখাইল আর্টিশিবেশেভের উপন্যাসের নায়ক সিনানের কথা মনে পড়ে। শ্যাম ছিল একজন আদ্যোপান্ত প্রেমিক, কিন্তু তার কাছে প্রেম ভালোবাসা ব্যাপারটা নিজের জন্য কৃত কাজ নয়। সে যে কোনও সুন্দর জিনিসের জন্য মরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল, আমার মনে হয় মৃত্যুও যথেষ্ট সুন্দর না হলে সে এতো সহজে মরতে পারত না।
সে ঘনিষ্ঠতার প্রাবল্য পছন্দ করতো। লোকে বলে মৃত্যুর হাত নাকি অতিশয় ঠাণ্ডা, কিন্তু আমি সেসবে বিশ্বাস করিনা। যদি সেরকম সত্যি হত, তাহলে শ্যাম তাদেরকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলতো, ‘এই মেয়েছেলে তুমি তফাৎ যাও দিকি, তোমার মধ্যে বিন্দুমাত্র উষ্ণতা নেই।’
সে একটা চিঠিতে লিখেছেঃ
দোস্ত, খুব গুছিয়ে বিস্তারিত ভাবে বলি অথবা খুব ছেঁটেছুটে অতীব সংক্ষেপে বলি এখানের সবাই আসলে ‘হিপটুললহা’ কিন্তু আসল ‘হিপটুললহা’ অনেক দূরে, সুদূর দূরে চলে গেছে। আমার জন্য অন্তত, এইসবের কারণে কোনোরকম অশান্তি বা অভিযোগের প্রশ্নই নেই... জীবন দিব্ব্যি গড়গড় করে গাড়ির মতো এগোচ্ছে, নিদারুণ ভালো সময় আর অঢেল মদ্যপান, মদ্যপান আর দেদার নিদারুণ ভালো সময়। তাজী ছমাস পরে ফিরেছিল। এখনও সে আমার অন্যতম গভীর দুর্বলতা। তুমি জানোই যে জীবনে এরচেয়ে বৃহত্তর কোনও আনন্দ নেই, নারীর ভালোবাসার উষ্ণতা গ্রহণ করা ছাড়া। আদতে, আমি একজন মানুষ, অতীব সাধারণ একজন মানুষ। আমি নিগারের [অভিনেত্রী নিগার সুলাতানা] কাছে অনেকবার অনিয়মিতভাবে এর মধ্যে গেছি এসছি, কিন্তু এখনও আমার উপর প্রথম অধিকার এবং আমার অবলম্বন তাজী। সন্ধ্যেগুলোতে আমরা তোমার বাজে বকার অভাব খুবই অনুভব করেছি।
শ্যাম কথার মধ্যে মাঝে মধ্যেই ‘হিপটুললহা’ শব্দটা বলতো—এই শব্দের জন্য একটা ভাষ্য/ বিবৃতি প্রয়োজন।
সুন্দর শ্যাম চাড্ডা
আমি তখন বোম্বে টকিজে কাজ করি। সেই সময়ে, কমল আমরোহী’র গল্প হাভেলী, যেটা থেকেই পরে মহল নামের ফিল্মটি তৈরি হবে, সেই গল্পের একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ের কাজ চলছে। অশোককুমার, ভাচা, হাস্রাত লুধিয়ানভি আর আমার মাঝে মধ্যেই আলাপ আলোচনা গল্প আড্ডা হত, প্রায় প্রতিদিনই, শুধু ফিল্মের গল্প নিয়ে নয়, বরং আরও নানা বিষয়ে, রটনা পরচর্চা থেকে কুৎসা কেলেঙ্কারি কিছুই বাদ যেতো না। শ্যাম তখন মজবুর নামের ফিল্মের শুটিং-এ কাজ করতো আর কাজকম্ম গুটিয়ে গেলেই আমাদের আড্ডায় এসে যোগ দিত।
কমল আমরোহী’র একটা স্বভাব ছিল খুব ভারী ভারী সাহিত্যজাত শব্দ এবং ব্যঞ্জনা অতি-সাধারণ কথার মধ্যেও ঢুকিয়ে দিত, যাতে আমাকে বেশ সমস্যায় পড়তে হতো, কারণ আমি হয়তো খুব সাধারণ একটা ব্যাপার নিয়ে আরও সাধারণ ভাষায় বলছি, আমি দেখতুম ওঁকে প্রভাবিত করা তো দূরস্থান, খুশী করতেই পারছি না। আমি যদি ওঁর মতো একটু ভারী শব্দ আর ধরন দিয়ে বলি দেখি অশোক আর ভাচার মাথার ওপর দিয়ে সেসব কথা উড়ে কোন অজ্ঞাত স্থানে চলে যাচ্ছে, কিছুই ওদের কাছে পৌচ্চাচ্ছে না। ফলস্বরূপ আমি একটা জগাখিচুড়ি অদ্ভুত পদ্ধতি এবং শব্দবন্ধ দিয়ে কথা বলা শুরু করেছিলাম যা আমি বেশ বুঝতে পারতাম।
একদিন সকালে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রেনে চেপে বোম্বে টকিজের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি, খবরের কাগজ খুলে, খেলার খবরে গতকালের ব্রেবোর্ণ স্টেডিয়ামের ক্রিকেট ম্যাচের স্কোরকার্ড দেখছি, তখনই একটা আশ্চর্য শব্দে আমার চোখ আটকে যায়ঃ ‘হিপটুললহা’। আজ অবধি এমন কোনও শব্দ আমি কোনদিনও শুনিনি বা পড়িনি। আমি ভেবেছিলাম, যে এটা হয়তো ‘হেইবাতুল্লাহ’ ভ্রমপূর্বক রূপ হবে, হয়তো এ একেবারেই ছাপার ভুল।
যখন আমি স্টুডিয়োতে পৌঁছালাম, তখন ফিল্মের চিত্রনাট্য নিয়ে মিটিং শুরু হয়ে গেছে। তার স্বভাবসিদ্ধ বাচনভঙ্গীতে কমল একটা পর্বের দৃশ্য বর্ণনা করছে। তার বলা মিটে গেলে, অশোক আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ‘কি মান্টো ঠিক লাগছে তো?’
আমি জানিনা কেন আমি নিজেকে বলতে শুনেছিলাম, ‘হ্যাঁ কমবেশি ঠিকই আছে–তবে খানিক ‘হিপটুললহা’ কম আছে।
চলবে...
সুশোভন প্রামাণিক
__________________
১৬.০৭.২০২০
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন