ভারতবর্ষের খোঁজে: সুকুমারী ভট্টাচার্য— এক অনন্ত অন্বেষা




তাঁর জন্ম হয়েছিল এক বাঙালি খ্রিশ্চান পরিবারে, একে ‘বিধর্মী’ তায় ‘মেয়েমানুষ’ (এই শব্দটি নিয়ে তিনি মজা করে বলতেন, ‘মেয়েমানুষ’ অর্থাৎ আগে ‘মেয়ে’ পরে ‘মানুষ’) কাজেই তাঁকে সংস্কৃত পড়ার অধিকার দেয়নি ‘সমাজের মাথা’রা। কিন্তু সত্যিকারের মেধার দীপ্তি কবে আর চাপা থেকেছে! সমগ্র পৃথিবী তাঁকে চিনেছে ভারতের সংস্কৃত সাহিত্য ও ইতিহাসের আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন অধ্যাপক হিসেবে, তিনি প্রখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ্‌ সুকুমারী ভট্টাচার্য। আজ ১২ জুলাই ২০২০, তাঁর জন্মশতবর্ষের সূচনা। 



এক 


‘ইন্ডোলজি’ বা ‘ভারততত্ত্ব’ – ধারে-ভারে বেশ ভারী একটা শব্দ, চর্চার ক্ষেত্রটিও খুব একটা সহজ নয়। নিছক ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান বা পুরাণ বিশ্লেষণ নয়, আবার এই তিনেরই সমন্বয়। তারই সঙ্গে মিশে থাকে রাজনীতির অতীত আর বর্তমান নির্মাণ, বিশ্বাস, সংস্কার, নৃতত্ত্ব, অর্থনীতি আরও কত কী। এক কথায় প্রাচীন ভারতের চিত্তাকর্ষক অথচ জটিল এক রোমাঞ্চের অন্বেষণ। বেদের মন্ত্রে যেখানে মিশে থাকে ক্ষুধার স্বর, অসহায় মানুষের ভীতির প্রচ্ছদে আঁকা হয় দেবতার গ্রাস, ঘটে দেবতার জন্ম। সৃষ্টির ওপার বিস্ময়ে জাগরূক হয় উপনিষদ, স্বয়ং মৃত্যুকেও যেখানে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করেন নাছোড় নচিকেতা। মহাকাব্যের মহান গরিমার সঙ্গেই সেখানে মিশে থাকে প্রান্তবাসীর স্বর।

এই ভারতবর্ষকে যদি জানতে চান, চিনতে চান তাহলে জানতে হবে যে মানুষটিকে তিনি ভারততত্ত্ববিদ্‌ সুকুমারী ভট্টাচার্য। অসামান্য প্রজ্ঞাবান এই মানুষটি ছিলেন এমনই একজন, যিনি সেই প্রাচীন ভারতের ধূসর রাজপথে কিংবা অলিতে-গলিতে অনায়াসে বিচরণ করেও নিজের মনটিকে রেখেছিলেন সবুজ-সতেজ ও মুক্ত। আর সেকারণেই তাঁর বিপুল জ্ঞানের ভাণ্ডারে মণিমুক্তের মতো শোভা পায় বৈদিক সাহিত্য থেকে মহাকাব্যের বিশ্লেষণ, সমাজ, নারী থেকে ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্য, এমনকি রবীন্দ্রনাথও। 

একশো বছর আগে আজকের দিনে, ১৯২১ সালের ১২ জুলাই মেদিনীপুরে তাঁর জন্ম হয়েছিল একটি বাঙালি ক্যাথলিক খ্রিষ্টান পরিবারে। এই পরিবারটি সম্পর্কযুক্ত ছিল মাইকেল মধুসূদন দত্ত-এর সঙ্গে, ভারতীয় মহাকাব্যকে যিনি আধুনিক জিজ্ঞাসায় প্রথম বিনির্মাণ করেছিলেন। ঐতিহ্যকে সনাতন বলে মেনে নেওয়ার বদলে যুক্তিনিষ্ঠ প্রশ্ন করার সাহস তাই হয়তো সুকুমারী ভট্টাচার্যের রক্তেই ছিল।    

পড়াশোনায় অসম্ভব মেধাবী ছিলেন তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি এ পাশ করে ১৯৪৩-৪৪ সালে সংস্কৃতে এম এ করার জন্য দরখাস্ত করেছিলেন। কিন্তু তখনকার ব্রাহ্মণশাসিত সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থার কর্তারা বাধা হয়ে দাঁড়ালেন। একে বিধর্মী তায় মহিলা, শাস্ত্রে বলা আছে এদের বেদাধিকার নেই, অতএব সংস্কৃত পড়ার দরখাস্ত নাকচ হল। একপ্রকার বাধ্য হয়ে সুকুমারী ভট্টাচার্য তাই ইংরেজিতে এম এ পড়লেন। কিন্তু সংস্কৃত ছিল তাঁর মজ্জায়, তাঁর চেতনায়। বাধ্য হয়ে শেখা ইংরেজি কিন্তু শাপে বর হল। পরবর্তীকালে তাঁর গবেষণায় যে তুলনামূলক বা comparative দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা গেছে তাঁর মূলে ছিল সংস্কৃত এবং ইংরেজি— উভয় ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর অসামান্য দখল। পৃথিবীবিখ্যাত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ভারতীয় দেবভবনা, দেবতত্ত্ব নিয়ে পি এইচ ডি করেছিলেন এবং তাঁর প্রথম বই ‘Indian Theogony’ (১৯৭০) প্রকাশিত হয়েছিল কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে। বিরল এই সম্মানের অধিকারী ক’জন ভারতীয় হতে পেরেছেন সন্দেহ আছে! তাঁর সংস্কৃতে এম এ করার স্বপ্ন অবশ্য পরে পূরণ হয়েছিল, ইংরেজিতে এম এ করার বছর দশেক পরে। 





ইংরেজীতে এম এ করার পর তিনি লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে ইংরেজির অধ্যাপনা করেছিলেন প্রায় দশ বছর। এরপর ১৯৫৭ সালে বুদ্ধদেব বসু্র অনুরোধে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে পড়াতে শুরু করেন। কয়েক বছর পরেই তাঁর সংস্কৃত অনুরাগী মন তাঁকে সংস্কৃত বিভাগে টেনে আনে, এরপর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সঙ্গেই আজীবন জড়িয়ে ছিলেন সুকুমারী ভট্টাচার্য। ১৯৮৬ সালে এখান থেকেই তিনি অবসর গ্রহণ করেন। 

অধ্যাপক হিসেবে নিজে যেমন ছিলেন অসামান্য, তেমনই শিক্ষার্থী থাকাকালীন সান্নিধ্য পেয়েছিলেন আরেক প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপকের, তিনি ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। আচার্যকে স্মরণ করে একটি জীবনীগ্রন্থও রচনা করেছিলেন সুকুমারী দেবী। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন মার্ক্সবাদী ইন্দোলজিস্ট-সংস্কৃতজ্ঞ। সমস্ত রকম মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা তিনি সর্বদা করেছেন। ব্যক্তিজীবনেও ছিলেন পরমতসহিষ্ণু এবং প্রখর যুক্তিবাদী। তাঁর জ্ঞান ও বিশ্লেষণী শক্তি তাঁকে তাঁর জীবৎকালেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারততত্ত্ববিদ্‌ করে তুললেও, দেশের অভ্যন্তরে তিনি তেমন কোনও সম্মান পাননি। হয়তো কোন বিশেষ-বৃত্তে থাকতেন না বলেই আনন্দ পুরস্কার ও সুরেশচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার ছাড়া আর কোন পুরস্কার পাননি।  

তাঁর স্বামী অমল ভট্টাচার্য ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজির খ্যাতনামা অধ্যাপক। কন্যা তনিকা সরকার ও জামাই সুমিত সরকার (ঐতিহাসিক সুশোভন সরকারের পুত্র) দুজনেই প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসবিদ্‌। ১৯৮৬ সালে অবসর গ্রহণের পর সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর নাকতলার বাড়িতে থেকেই চালিয়ে গিয়েছিলেন গবেষণা ও লেখালিখি। শেষ কয়েকটি দশকে, বিশেষ করে নয়ের দশক ও তৎপরবর্তী নয়া শতাব্দীর প্রথম দশকের বিবর্তমান ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। তবু অক্লান্ত এক সেনানীর মতো লিখে গিয়েছেন নতুন নতুন বই। গুলিয়ে দেওয়া ধর্মীয় উল্লাসসুরের বিপরীতে লড়াই করার জন্য সাধারণ মানুষকে নিজের জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে তুলে দিয়েছেন ‘বিবাহ প্রসঙ্গে’ (১৯৯৬), ‘বেদের যুগে ক্ষুধা ও খাদ্য’ (১৯৯৮) ‘গীতা কেন?’ (২০১০)-এর মতো সহজ ভাষার বই। ২৫ মে ২০১৪ সালে নাকতলার বাড়িতেই তাঁর জীবনাবসান হয়। কিন্তু মৃত্যুতেও অক্ষয় থাকেন সুকুমারী ভট্টাচার্য, সমস্ত মেধার প্রজ্ঞায় তিনি যেমন আমাদের দিয়ে গিয়েছেন ভারতবর্ষকে দেখার মন্ত্র তেমনই তাঁর দেহটি পর্যন্ত দান করে গিয়েছিলেন আর জি কর হাসপাতালে চিকিৎসাবিদ্যার গবেষণার জন্য।






দুই 


অনেকের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায় বারবার লক্ষ করেছি, মানুষ সুকুমারী ভট্টাচার্য প্রসঙ্গে কথা বলতে সকলেই তাঁর মানবদরদী সত্তার কথা বলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীকে তিনি বিপদে সাহায্য করতেন, বিশেষ করে সমাজের মেয়েদের অবস্থান, অসম্মান আর অত্যাচার তাঁকে প্রবলভাবে নাড়া দিত। তাঁর বেশ কিছু লেখালিখির সূত্রও নিহিত রয়েছে এই মানবিক মনোভঙ্গির মধ্যে।  

লক্ষ করলে দেখা যায় তাঁর লেখায় বারে বারেই শূদ্র ও নারীদের উপর হওয়া অত্যাচারের ঐতিহাসিক সমাজতাত্ত্বিক শিকড় অনুসন্ধান প্রাধান্য পেয়েছে। ‘প্রাচীন ভারত: সমাজ ও সাহিত্য’ (১৯৮৮) এবং ‘Women and society in ancient India’ (১৯৯৯) যার বাংলা অনুবাদের নাম ‘প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ’ এবিষয়ে বিশেষ উল্লেখযোগ্য।  

১৯৯৮ সালে তিনি লেখেন ‘বেদের যুগে ক্ষুধা ও খাদ্য’ বইটি। এই বইতে তিনি দেখিয়েছেন যে তথাকথিত ভারতীয় সভ্যতার স্বর্ণযুগ বলে যে বেদের যুগকে বলা হয়, ক্ষুধা আর খাদ্যের হাহাকার কি প্রবলভাবে সে যুগেও ছিল। ঋগ্‌বেদ, সাম্‌বেদ থেকে উদাহরণ তুলে তুলে তিনি দেখিয়েছেন ক্ষুধার চিত্র। বেদ ও বৈদিক যুগ নিয়ে যে মিথ— সুকুমারী ভট্টাচার্য সেই মিথকে এখানে ভেঙে দেন। বঙ্কিমের ‘বন্দে মাতরম্‌’ গানের ‘সুজলাং সুফলাম্‌’-এর নির্মাণ তখন ঐতিহাসিকভাবে প্রশ্নের মুখে পরে। এই বইটি বর্তমান সময়েও ভীষণ প্রাসঙ্গিক। বিশ্ব ক্ষুধাসূচকে সেঞ্চুরি হাঁকানো অতিমারি বিধ্বস্ত দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা এই বইটি পড়লে বুঝতে পারব ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসে ক্ষুধার সংকট, অসাম্যের সামাজিক ইতিবৃত্ত কত গভীরে প্রোথিত। তাঁর আরেকটি বই এ প্রসঙ্গেই মনে পড়ে, ‘বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য’, কথায় কথায় ‘সব ব্যাদে আছে’ বলে যারা দোহাই পাড়েন তাঁদের বিরুদ্ধে এই বই দেখায় যে সংশয় আর প্রশ্ন কীভাবে ভারতের আদি ঐতিহ্যে মিশে আছে।

    প্রকৃতপক্ষে সুকুমারী ভট্টাচার্য এক আপোষহীন জীবন সংগ্রামেরই নামান্তর। আজীবন বামপন্থী রাজনীতিতে আস্থাশীল এই মানুষটি সর্বদা সক্রিয় থেকেছেন প্রগতিশীলতার চর্চায়। তাঁর প্রথম জীবনে সংস্কৃত পড়তে গিয়ে প্রাচীনপন্থী পণ্ডিতদের কাছে যে বাধা পেয়েছিলেন, তাতে তিনি দমে যান নি, বরং লড়াই করেছেন। জিতেছেন সেই লড়াই, গোটা বিশ্ব তাঁকে সংস্কৃতজ্ঞ ভারততত্ত্ববিদ্‌ বলে সম্মান করেছে। বিশ্বের সর্বত্র তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য প্রশংসিত হয়েছে। প্রাচীন ভারত সম্বন্ধিত চর্চায় তুলনামূলক ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবহারের সূত্রপাত কার্যত তাঁরই হাতে ঘটেছিল। সেই সঙ্গে সমাজতাত্ত্বিক বৈজ্ঞানিক ইতিহাস অনুসন্ধানে নৃতত্ত্ব এবং ভাষাতত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গির সফল প্রয়োগও তিনি করেছেন। বেদ, উপনিষদ, মহাভারত, রামায়ণ, গীতা, সাহিত্য, অলংকার, ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র, দর্শন, বৌদ্ধ সাহিত্য, বাংলা সাহিত্য, এমনকি রবীন্দ্রসাহিত্যও তাঁর কলমে বিশ্লেষিত হয়েছে।  

    রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যও তিনি কিছুটা পেয়েছিলেন, তাঁর পিসিমা বিদ্যুৎপ্রভা দেবী শান্তিনিকেতনে ডাক্তারি করতেন। রবীন্দ্রনাথের দর্শন তাঁকে প্রভাবিত করেছিল তা বোঝা যায় ভারতের সনাতন ঐতিহ্যকে চিরাচরিত সত্য বলে আপ্তবাক্যের মতো মেনে না নিয়ে, তাকে প্রশ্ন, যুক্তি আর সত্যের পরীক্ষায় যাচাই করার তাঁর জীবনব্যাপী কর্ম প্রচেষ্টায়। এ যেন গোরা উপন্যাসের পরেশবাবুর সেই বিখ্যাত সংলাপটিই মনে করিয়ে দেয়: 


বিরোধ ও বাধা ছাড়া সত্যের পরীক্ষা হতেই পারে না। সত্যের পরীক্ষা যে কোনো এক প্রাচীনকালে এক দল মনিষীর কাছে একবার হয়ে গিয়ে চিরকালের মতো চুকেবুকে যায় তা নয়, প্রত্যেক কালের লোকের কাছেই বাধার ভিতর দিয়ে, আঘাতের ভিতর দিয়ে সত্যকে নূতন করে আবিষ্কৃত হতে হবে। 

(‘গোরা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।)


      বস্তুত সুকুমারী ভট্টাচার্যের সারাজীবনের অন্বেষণ এই কথাগুলিরই নামান্তর বলা চলে। কিন্তু কিছু ক্ষুদ্র-মনের মানুষ এই প্রচারও করেন যে, সুকুমারী দেবী ক্রিশ্চান ছিলেন বলেই হিন্দুধর্মের ওপর তাঁর এতো আক্রোশ। কিন্তু সুকুমারী ভট্টাচার্যকে যারা চেনেন তাঁরা জানেন কোনো ধর্মের প্রতিই তাঁর কোনও পক্ষপাত বা আক্রোশ কোনটাই ছিল না। বরং ‘জাতের নামে বজ্জাতি করা’ মানুষদের বিরুদ্ধে স্পর্ধার নাম ছিলেন সুকুমারী ভট্টাচার্য। 

১৯২১ থেকে ২০১৪ — দীর্ঘ চুরানব্বই বছরের জীবনকালে সুকুমারী ভট্টাচার্য দেখেছিলেন সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতির অনেক বাঁক বদল। অনেকটা ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শী তিনিক্রিশ্চান নারী বলে সংস্কৃত পড়তে বাধা দেওয়ার সমাজ কাঠামো থেকে আজকের যুগে ঘরে-বাইরে কর্মরত মেয়েদের ছবি, সেই ছবির পাশেই ধর্ষিত নাবালিকার ছবি, পণের জন্য পুড়িয়ে মারা বধূর ছবি— তিনি দেখেছেন। আর সেজন্যেই হয়তো ভারতীয় নারীদের নিয়ে তাঁর গভীর অন্বেষণী অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে ‘প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ’, ‘বিবাহ প্রসঙ্গে’ বা ‘এয়োতি এবং’-এর মতো বইগুলিতে।  আজকের ভারতের কাছে সুকুমারী ভট্টাচার্য তাই এক সাহসের নাম, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, মৌলবাদের উল্লাসি তলোয়ার কিংবা ত্রিশূলের বিরুদ্ধে সুকুমারী ভট্টাচার্য ও তাঁর কাজ এক স্পর্ধিত আলোক মশাল। 

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটি কবিতা মনে পড়ে, যেখানে এক নৈশ্য বিদ্যালয়ের গুরুমশাই রাতের অন্ধকারে মানচিত্র মেলে ধরে দেখাতে চায়, চেনাতে চায় দেশ— “দেশ দেখাচ্ছ অন্ধকারে:/ এই যে নদী, ওই অরণ্য, ওইটে পাহাড়,/ এবং ওইটে মরুভূমি। দেশ দেখাচ্ছ অন্ধকারের মধ্যে তুমি,/ বার করেছ নতুন খেলা।/... দম-লাগানো কলের মতন হাজার কথা শুনিয়ে/ যাচ্ছ। / গুরুমশাই/ অন্ধকারের মধ্যে তুমি দেশ দেখাচ্ছ।” কবিতার এই অন্ধকারের গুরুমশাই-এর মতোই আমাদের চারপাশেও অনেক ‘নৈশ’ বিদ্যালয়ের আয়োজন আজ ঘনিয়ে ওঠে, যেখানে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয় ভারতবর্ষের ইতিহাস, ভারতবর্ষের সংজ্ঞা। কাজেই  “নৈশ বিদ্যালয় থেকে চুপি চুপি/পালিয়ে” এসে প্রকৃত ভারতবর্ষের দিকে আলো ফেলতে সুকুমারী ভট্টাচার্যই হোক আমাদের আলোকবর্তিকা, আমাদের ‘গুরুমশাই’; তাঁর জন্মশতবর্ষে এই হোক আমাদের শপথ।

 

 

 


 



সুকুমারী ভট্টাচার্য: সংক্ষিপ্ত গ্রন্থপঞ্জি 

 

ইংরেজি বই: 

  • The Indian Theogony, Cambridge University Press, 1970 (বর্তমানে মোতিলাল বনারসীদাস ও একটি মার্কিন সংস্করণ)

  • Literature in the Vedic Age (2 vols), K. P. Bagchi and Co., 1984 (Vol 1)

  1. ( Vol 2). 

  • Buddhist Hybrid Sanskrit Literature, The Asiatic Society, 1992.

  • History of Classical Sanskrit Literature, Orient Longman, 1993.

  • Religion Culture and Government, Sangam Books, 1993.

  • Women and Society in Ancient India (Collection of essays), Basumati Corporation Ltd, 1994.

  • Fatalism in Ancient India, Baulman, 1995. 

  • Legends of Devi, Orient Longman, 1995. 

  • Fate and Fortune in the Indian Scriptures, Foundation Books, 1995.

  • In Those Days (Collection of essays), CAMP, 2001.

  • Myth: Vedic, Buddhist and Brahmanical, Progressive Publishers, 2006.


বাংলা বই

  • সংস্কৃত মৃচ্ছকটিক নাটকের বঙ্গানুবাদ, সাহিত্য আকাদেমি, ১৯৭৩। 

  • প্রাচীন ভারত: সমাজ ও সাহিত্য, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৮৮। 

  • সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি। 

  • বিবাহ প্রসঙ্গে, CAMP, ১৯৯৬। 

  • রামায়ণ ও মহাভারত – আনুপাতিক জনপ্রিয়তা, CAMP, ১৯৯৬। 

  • বেদের যুগে ক্ষুধা ও খাদ্য, চিরায়ত প্রকাশন, ১৯৯৮।

  • বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০০০।

  • বাল্মিকীর রাম – ফিরে দেখা, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, ২০০২।  

  • অপসংস্কৃতি, CAMP, ২০০৩।

  • রবীন্দ্রকবিতায় মৃত্যু, CAMP, ২০০৭।

  • গীতা কেন?, CAMP, ২০১০।     

  • প্রবন্ধ সমগ্র (৪ খন্ড), গাংচিল, ২০১২।

(তালিকাটি অসমাপ্ত) 

 

ঋণ: 

১। দীপক ভট্টাচার্য (সম্পাদিত), ভারত ও ভারততত্ত্ব: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, কলকাতা: ন্যাশন্যাল বুক এজেন্সি, ২০০৪    

২। আফিক ফুয়াদ (সম্পাদিত), সুকুমারী ভট্টাচার্য বিশেষ সংখ্যা, দিবারাত্রির কাব্য পত্রিকা, কলকাতা, ২০১৪। 

৩। ড. তপোধীর ভট্টাচার্য, শতবর্ষের আলোকে ভারততত্ত্ববিদ সুকুমারী ভট্টাচার্য, উত্তরসূরি গ্রুপ ইউটিউব চ্যানেলে ২৯/০৬/২০২০-তে প্রদত্ত বক্তৃতা – <https://youtu.be/b5qMbtUjYB0> dt. 8.07.2020, 6:00 pm




সানু ঘোষ, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা

১২/০৭/২০২০  


মন্তব্যসমূহ

  1. এই মন্তব্যটি একটি ব্লগ প্রশাসক দ্বারা মুছে ফেলা হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. ধন্যবাদ। এভাবেই আমাদের পাশে থাকুন। বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস নিয়ে এরকমই আরও আকর্ষণীয় লেখা পড়তে চোখ রাখুন আমাদের ব্লগে।

      মুছুন
  2. লেখাটি পড়ে সম্বৃদ্ধ হলাম।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. ধন্যবাদ। এভাবেই আমাদের পাশে থাকুন। বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস নিয়ে এরকমই আরও আকর্ষণীয় লেখা পড়তে চোখ রাখুন আমাদের ব্লগে।

      মুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চোদ্দ ভূতের আসরে

পার্টিশনের জীবনভাষ্য: প্রজন্মান্তরের খোঁজ

বুদ্ধের পুতাস্থি: রাখা রয়েছে কলকাতাতেই