কবিরে ত্যজিয়া রেখেছ কবির এ গৌরব
পিজি ওয়ানের শেষ ছ-মাস। আমাদের কোর্স নাম্বার ২.৪, 'বাংলা কবিতা পর্ব ১' অংশে 'রবীন্দ্র কবিতা'। ক্লাস প্রায় শেষের দিকে, পরীক্ষা শুরু হয় হয়। স্টাডি লিভ পড়তে আর কিছুদিন বাকি। আমাদের মাস্টারমশাই জয়দীপ ঘোষ, সকলের ভালোবাসার 'জয়দীপদা'। শেষের দিকের ক্লাস বলে লোকসংখ্যা একটু কম। রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু কবিতা ইতোমধ্যেই পড়ানো শেষ, এইটেই সম্ভবত ওঁর শেষ ক্লাস। আর যেহেতু আমাদের পিজি ওয়ান ফলে বিদায় বেলার সময়ও ঘনিয়ে আসছে। সেই ক্লাসে স্যার যে কবিতাটি পড়াবেন সেটির নাম অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ঠিক আগের বছর অর্থাৎ ১৯৪০-এ প্রকাশিত হয় সানাই কাব্যগ্রন্থ। এটি সেই কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন সম্ভবত ১৯৪০-এর ১৬-ই জুলাইয়ে, শান্তিনিকেতনে। আবারো বলছি, ১৯৪০ সাল, আর একবছর পরেই রবীন্দ্রনাথ মারা যাবেন; অর্থাৎ জীবনের একদম শেষের দিককার একটি কবিতা।
কবিতাটি শুরু হচ্ছে এইভাবে,
পূর্ণ হয়েছে বিচ্ছেদ, যবে ভাবিনু মনে,
একা একা কোথা চলিতেছিলাম নিষ্কারণে।
শ্রাবণের মেঘ কালো হয়ে নামে বনের শিরে,
খর বিদ্যুৎ রাতের বক্ষ দিতেছে চিরে,
দূর হতে শুনি বারুণী নদীর তরল রব–
মন শুধু বলে, অসম্ভব এ অসম্ভব।
এমনি রাত্রে কতবার, মোর বাহুতে মাথা,
শুনেছিল সে যে কবির ছন্দে কাজরি-গাথা।
রিমিঝিমি ঘন বর্ষণে বন রোমাঞ্চিত,
দেহে আর মনে এক হয়ে গেছে যে-বাঞ্ছিত
এল সেই রাতিবহি শ্রাবণের সে-বৈভব–
মন শুধু বলে, অসম্ভব এ অসম্ভব।
মিলনের পর বিচ্ছেদের ভাবনায় যখন কথক ভাবিত, একা একা কোথাও কারণবিহীনভাবে তিনি চলেছেন; এরকম পরিস্থিতিতে শ্রাবণের মেঘ, বিদ্যুতের ঝলকানি আর মনের মধ্যে কারো কন্ঠস্বরে ধ্বনিত হওয়া শব্দ 'অসম্ভব'। পূর্ব স্মৃতি ঘেঁটে কথকের মনে পড়ে যায় এমনিই কোনো রাত্রে সেই ব্যক্তি কথকের হাতে রেখেছিলেন মাথা, বৃষ্টিতে বনের মধ্যে তৈরি হওয়া রোমাঞ্চ যেন দুটি শরীর ও মনকে এক করেছিল। অথচ আজ সেই রাতের স্মৃতিগুলোই কার্যত জীবন্ত মনে হয়েছে কথকের, আর বারবার তিনি 'অসম্ভব' বলে চেয়েছেন সেটিকে নাকচ করে দিতে। এখানে দুটি শব্দ আমাদের ভাবাতে পারে। 'বারুণী নদী' এবং 'তরল রব'। বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণকান্তের উইল-এর সৌজন্যে আমরা অনেকেই 'বারুণী পুষ্করিণী'-র সঙ্গে পরিচিত। সেই পুষ্করিণী যেখানে রোহিনী ও গোবিন্দলালের সাক্ষাৎ হয়, তাছাড়া বাদবাকি অবস্থার বিবরণ বঙ্কিমবাবুই আমাদের বলেছেন সবিস্তারে। এই কবিতায় সেই 'বারুণী'-র কথা আসে বটে যদিও সেটি নদী। দ্বিতীয় শব্দ 'তরল রব'। তরলতার মধ্যে যখন 'রব' খুঁজে পাওয়া যায় তখন সেই তরল হয়ে ওঠে আসন্ন আলোড়নের পূর্বাভাস স্বরূপ।
এরপর একে একে কথক সেই অতীতকে আঁকতে থাকেন। কখনো 'বেণীবাঁধনের মালায়', কখনো সেতারের সুরে, কখনো বা নবমালতীর সৌরভে কিন্তু শেষ স্তবকে ঠিক শেষের আগের লাইনে গিয়ে একটা খটকা লাগে। কবিরে ত্যজিয়া রেখেছ কবির এ গৌরব, এতক্ষণ পর্যন্ত কবিতাটা বেশ এগোচ্ছিল। একের পর যেভাবে অতীতচারিতা করতে করতে, অসম্ভবের পথ রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাতে আমাদের বিষয়টা উপভোগ্যই হয়ে উঠছিল বেশ। কথকের অপরদিকে থাকা মানুষটিকে আমরা অনেকেই একটি মেয়ের অবয়বে রূপদানও করেছিলাম হয়তো। ভালোবাসার পর্যায়ে এগোতে এগোতে একসময় এক পারস্পরিক আকাঙ্ক্ষার মুহূর্তও হয়তো আমাদের কল্পনায় এসে গিয়ে থাকবে; তারপর গোটা কবিতা জুড়ে যে অসংখ্য ছবি ছিটিয়ে রয়েছে সেগুলোকেও আমরা এক করার চেষ্টা করব। সব সমীকরণ কেবল ওই শেষের আগের লাইনে গিয়েই যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেল। সমস্ত কবিতার ফুটে ওঠা ভালোবাসা কি তখন কেবল আর দুই মানব-মানবীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল, নাকি কবির সমস্ত সৃষ্টির অন্তিম মুহূর্ত যে আসন্ন তার আভাস জানিয়ে দিয়ে গেল? মানুষটি রবীন্দ্রনাথ। মৃত্যুর কিছুদিন আগেও তিনি লিখে যেতে পারেন,
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম আপনার রূপ চিনিলাম আপনারে আঘাতে আঘাতে বেদনায় বেদনায়।তাই এই ভালোবাসার কবিতাকেও এভাবেই যেন মাত্রাদান করেন তিনি, মৃত্যুর ঠিক কিছুকাল আগে; ভালোবাসা তাঁকে ছেড়ে যেতে পারে না।
নীচের ছবিটি জে.এম.ডব্ল্যুউ টার্নারের আঁকা। টার্নার অষ্টাদশ-উনিশ শতকের এক ব্রিটিশ চিত্রকর, রোমান্টিক যুগের। অদ্ভুত তাঁর জীবন। সমুদ্রের ঝড়কে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন নিজের জীবনে বারবার। শোনা যায় নিজেকে নাকি মাস্তুলের সঙ্গে বেঁধে রাখতেন, ঝড় দেখবেন বলে। মারাও যান সম্ভবত নিউমোনিয়া বা ব্রঙ্কাইটিসে। তাঁর ছবিতে সমুদ্র, ঝড় এবং আকাশ নানাভাবে, বিবিধ রঙের দক্ষতায় এসেছে বারবার। এই ছবিটি দেখার পর রবীন্দ্রনাথের এই অসম্ভব কবিতাটার সাথে কেন জানি না মিলিয়ে পড়তে ইচ্ছে হল। দুটোর মধ্যে কোনো মিলই নেই হয়তো, আবার হয়তো অনেক মিল আছে। টার্নার মারা যান ১৮৫১-তে, রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১-তে। এই ছবিটি ১৭৯৬ সালে আঁকা, ছবিটির নাম ফিশারম্যান অ্যাট সী। ছবিতে এই অদ্ভুত রহস্যময় রঙের ব্যবহার এবং ওই ভাসতে থাকা একটি নৌকো, আলো আঁধারি চাঁদ, ঢেউয়ের ভাঙন যেন আসন্ন ঝড়ের ইঙ্গিত বহন করে না কোথাও? কোথাও কি অন্তরালে বইতে থাকে না এক অসম্ভবের বাতাবরণ কিম্বা ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা! কে জানে, মাছ ধরতে যাওয়া ওই মানুষটিও হয়তো তাঁর অতীতকে অনুভব করেন, এইরকম কোনো রাতে বারবার। সেই 'অসম্ভব'-ই যেন কবিতার 'অসম্ভব'-এর ছবিগুলোকে মিলিয়ে দেয় আমার কাছে, নতুনভাবে। এই অসময়ে যখন একের পর এক মৃত্যু আমাদের বারবার এক বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন করছে, তখন কেমন করে যেন এই কবিতা-ছবির মধ্যে দিয়েই একটু আশ্রয় উঁকি দিচ্ছে...
______________________
বিতান দে | ১৫.০৬.২০২০
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন