কেরি ফওলার স্বপ্ন বোনেন


১.


জীবনে অনেক কিছুই করতে পারতেন, শেষপর্যন্ত নরওয়ের স্বালভার্ড অঞ্চলে তৈরি করে তুললেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো সিড ভল্ট। বীজের ঠিকানা।

বলা হয়, পৃথিবীতে শুধু ধানই হতে পারে প্রায় লক্ষ রকমের। তার মধ্যে হাতে গোণা কয়েকরকমের ধানই তো আমরা ঘুরে ফিরে চাষ করি, তাই না? এমনি করে আমাদের অমনোযোগে আর অবিমৃষ্যকারিতায় হারিয়ে-যাওয়া, মুছে-যাওয়া লক্ষ লক্ষ দুর্লভ প্রজাতির শস্যবীজ কেরি ফওলার সংরক্ষিত করে চলেছেন আজও। কুটিল সভ্যতার বিরুদ্ধে এ তাঁর স্বেচ্ছাসংগ্রাম! অনেক চেষ্টায় গত ১৩ হাজার বছরের কৃষি-ইতিহাসের প্রায় সব বীজ তিনি সংগ্রহ করে তুলেছেন! এই বীজগুলি এখানে কার্যত ‘অমর’!

পৃথিবীর কাছে কিছু ঋণ রয়ে গেছে আমাদের। সমস্ত জীবনের সাধনা দিয়ে কেউ কেউ সেই ঋণশোধের কাজে মেতে আছেন, এইটা দেখলে মানুষ হিসেবে একটু গর্ব হয়!

২.


বিশ শতকের গোড়ায় এইরকম আর-এক সুবিশাল সিড-ভল্ট ছিল লেনিনগ্রাদ শহরে।

১৯৪১-এর ৮ সেপ্টেম্বর এই লেনিনগ্রাদ শহর সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ল হিটলার-বাহিনীর হাতে। জার্মান সমরনায়কেরা এই শহরটির ‘দখল’ চায় না, চায় অবরুদ্ধ মানুষগুলোকে তিলে তিলে শেষ করে দিতে। শুরু হল পরের ৮৭২ দিন ব্যাপী তীব্র অনাহারের এক অভূতপূর্ব মর্মন্তুদ অধ্যায়। অবরুদ্ধ শহরের নিজস্ব খাবারের সঞ্চয় ফুরোলো অল্প দিনেই। তারপর একতরফা মৃত্যু। ১৫ লক্ষ মানুষ মারা গেছিলেন স্রেফ না-খেতে-পেয়ে!

সেইসময়ে শহরের সিড-ভল্টটির দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল ছ’জন বিজ্ঞানীর উপর। দীর্ঘ দিনের চেষ্টায় সেখানে তাঁরা জমিয়েছেন বস্তা-বস্তা দুষ্প্রাপ্য নানা প্রজাতির চাল-গম, অন্য দানা শস্য। প্রশ্ন হল: এইটুকু সঞ্চয় লেনিনগ্রাদের ক্ষুধা মেটানোর পক্ষে নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর বটে, কিন্তু তাই দিয়ে কি আজ এই বিজ্ঞানীদল নিজেদের খিদেটুকু মেটাতে পারেন না? অন্তত কয়েক সপ্তাহের জন্যে?

পারেন তো বটেই। কিন্তু এ যে ভবিষ্যতের সমস্ত-মানুষের-জন্যে অতীতের সমস্ত-মানুষের-হয়ে জমানো সঞ্চয়! এ যে পৃথিবীর কাছে চিরঋণের দায়। একে কি আজ খেয়ে ফেলা যায়? ছ’জনে মিলে ঠিক করলেন, এই সঞ্চয় তাঁরা রক্ষা করবেন সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে।

এই ছ’জন বিজ্ঞানীর চারজন মারা গেছিলেন অনাহারে। তাঁদের মধ্যে একজন, দিমিত্রি ইভানভের দেহ পাওয়া যায় ওই ভল্টেরই মধ্যে। তাঁর মৃতদেহের অদূরেই রাখা ছিল বস্তায়-ভরা চাল-গমের দানা। না, সেখান থেকে একমুঠো শস্যও নিজের জন্যে তুলে নেননি তিনি! মৃত্যু তাঁর সংকল্পের কাছে জাস্ট গো-হারান হেরে গেছে!

তথ্য হিসেবে জানানো যাক, লেনিনগ্রাদের সেই আশ্চর্য সঞ্চয় আজ অতিযত্নে সংরক্ষিত আছে কেরি ফওলারের বীজবসতিতে।




আজ হিটলার নেই। তার লেবেনস্রাম নেই  কনসেনট্রেশন ক্যাম্প নেই। দুনিয়ার অধীশ্বর হওয়ার অশ্লীল স্বপ্ন মরে ভূত হয়ে গেছে কবেই! কিন্তু কী আশ্চর্য, ওই বীজগুলো সব আজও আছে। অঙ্কুরের সমস্ত সম্ভাবনা বুকে নিয়ে ওরা বেঁচে আছে এক বহুযত্নলালিত ঘরে। আর ওদের মধ্যে বেঁচে আছেঘৃণার আদিগন্ত প্রতাপ সত্ত্বেও বেঁচে আছেবিশ্বসংসারের প্রতি ছ'জন মানুষের অলৌকিক ভালোবাসা।

এরপরও মানুষের সম্পূর্ণ নিরাশ হওয়া কি সাজে? বলুন দেখি।

-------------------------------

জয়দীপ ঘোষ
২৪শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ইছাপুর

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চোদ্দ ভূতের আসরে

পার্টিশনের জীবনভাষ্য: প্রজন্মান্তরের খোঁজ

বুদ্ধের পুতাস্থি: রাখা রয়েছে কলকাতাতেই