কাঁহা গেলে তোমা পাই
রাতে ঘুমানোর অভ্যেস নেই বহুদিন। গোটা লকডাউন পর্বে মাছের চোখ হয়ে জেগে ছিলাম। কপাল ভালো থাকলে সকালে, না হলে দুপুরে বিকেলে সন্ধ্যেবেলা ঘোমাতে যাই। ক্লান্তিবশত কাল ঘুমিয়ে পড়েছিলাম রাতে। সকালে ঘুম ভাঙলে গান শুনতে শুনতে কিছু একটা বইয়ের কয়েক পাতা ওল্টাই।
তাকের ওপর রাখা কাঁহা গেলে তোমা পাই বইটা চোখে পড়লো। কাকতালীয়ভাবে ফেসবুকে কেউ একজন ক্ষিতীশচন্দ্র মজুমদারের আঁকা ছবি শেয়ার করেছিলেন। সকালেই বইটা একটু পড়তে ইচ্ছে হল, নতুন কিছু নয় বরং পাঁচ বছর আগে এই বই পড়ে যে পোস্ট লিখেছিলাম সেটা একটু কেটে-ছেঁটে বলি।
প্রাচী প্রকাশনী-র একটি ছোটো বই সেদিন কলেজ স্ট্রীটে আড্ডার ফাঁকে, টুলের ওপর উল্টে-পাল্টে দেখছিলাম, কাছে টাকা ছিল যৎসামান্য। দেখলাম, বইটির ছাপা এবং কাগজ খুবই মাঝারি বা খারাপের দিকেই, পড়া যায় এইটুকুই। বইটির প্রচ্ছদ এবং বাঁধাই তথৈবচ, বইটি বিষয়গুণে ভালো লেগে গেছিল, কিনে ফেললাম। মাত্র আশি টাকা দাম। কাঁহা গেলে তোমা পাই লেখক ড. জয়দেব মুখোপাধ্যায়। বইটা পড়ার আগেই বইয়ের দোকানী আমাকে এই লেখক-কে নিয়ে একটি দু-লাইনের গল্প বললেন, যে এই বই লেখার অব্যবহিত পরেই লেখক গুমখুন হয়ে যান।
আশ্চর্য। সামান্য একটি বই লেখার দায়ে!
বইটি বাড়িতে এনেই এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা গেলো। বলা ভালো শুরু করে আর থামা গেলো না। লেখক কি লিখেছেন কেনই বা বইটি পড়া উচিৎ এবং স্বীয় কর্তব্য এই বিষয়ে কোনও কথাই বলছি না, গল্পের ছলে লেখক এই সুবৃহৎ এবং বিতর্কিত অধ্যায় নিয়ে অপরূপ একটি লেখা লিখেছেন। তাঁর অভিপ্রায় ছিল এঁর দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ করার।
কিন্তু তার আগেই গুমখুন।
ফিরে গিয়ে আমি সেই বই দোকানিকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়েছি, বইটি কেনার আগে যখন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বইটি কেমন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, অনেকেই নাকি এই কৃশ গ্রন্থটি কেনেন আর যারা নাকি কেনেন তাঁরাই নাকি অন্যকে পড়তে বলেন। আমিও বইটি পড়ে অন্যদের জানাচ্ছি
যদি বিশ্বাস করে বইটি কিনে পড়েন, ঠকবেন না। সামান্য কটি টাকা আর কিছু সময় আপনার জীবন থেকে ব্যয় হবে।
কাজী নজরুল ইসলামের একটি গানের কথা মনে এলো, নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত রচনা অথবা ‘ওরে নীল যমুনার জল’ সবাই শুনেছেন, নীল যমুনার জল অত্যন্ত প্রিয় গান
নজরুল মহাপ্রভুকে নিয়ে এই অনন্য গানটি লিখেছিলেন,
গানটির কথা যদি খেয়াল করেন চমকে উঠবেন, বারবার
এইরকম করে এতো কঠিন কথা এতো সহজে এবং এই ভাষায় বলা যায়!
কাঁদবো না আর শচীদুলাল তোমায় ডেকে ডেকে
মোরা কাঁদবো না-
(প্রিয়) তুমি গেছ চলে তোমার প্রেম গিয়েছ রেখে
তাই কাঁদব না॥
ত্যাগ যেখানে প্রেম যেখানে
তোমার মধু-রূপ সেখানে
ওগো জগন্নাথের দেউল তোমায় রাখবে কোথায় ঢেকে॥
হল বৈরাগিনী ধরা তোমার চরণ ধূলি মেখে
তোমার মন্ত্র নিল অসীম আকাশ চাঁদের তিলক এঁকে।
সুন্দর যা কিছু হেরি
ওগো রূপ সে শচী-নন্দনেরি
তোমার ডাক শুনি যে আজও হৃদয়পুরীর সাগর থেকে।
তোমার ডাক শুনি যে ওহে প্রিয়
ডাক শুনি যে আজো হৃদয়পুরীর সাগর থেকে॥
এই গানের আশ্চর্য মধুর লাইন,
ত্যাগ যেখানে প্রেম যেখানে
আর কি অদ্ভুত সুন্দর ইমেজারি আর কথার ব্যবহার দেখুন,
হল বৈরাগিনী ধরা তোমার চরণ ধূলি মেখে
তোমার মন্ত্র নিল অসীম আকাশ চাঁদের তিলক এঁকে।
পৃথিবী তাঁর রাঙা ধুলোর ধূলি মেখে বৈরাগিণী হয়েছে আর অসীম আকাশ চাঁদের ‘তিলক’ এঁকেছে অর্থাৎ সেও গোঁসাইভাব অবলম্বন করেছে।
আর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যে দুটি লাইন, যে দুটির সঙ্গে মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের দুটি তত্ত্ব অথবা বিশ্বাস লুকিয়ে রয়েছে, একটি মত বলে মহাপ্রভু বিলীন হয়েছেন, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে, জগন্নাথ দেবের বিগ্রহের শরীরে আর একটি মত জানায় তিনি সংকীর্তনরত অবস্থায় অসীমের আহ্বানে পুরীর সমুদ্রে বিলীন হয়েছেন।
একটি লাইনে নজরুল লিখলেন,
ওগো জগন্নাথের দেউল তোমায় রাখবে কোথায় ঢেকে
কি সুতীব্র কশাঘাত! এবং অপর একটি লাইনে তিনি ওই সাগরে বিলীন হয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ আবছায়া ভাবে তুলেও এড়িয়ে গেলেন, আবার যেন তুললেনও বটে, সেই জন্য তিনি লিখলেন,
তোমার ডাক শুনি যে আজো হৃদয়পুরীর সাগর থেকে...
এই বিষয়ে একটি লেখার লিংক ও গানটি দিলাম।
____________________________
সুশোভন প্রামাণিক | ৭ই জুন, ২০২০
https://m.soundcloud.com/susovan-pramanik/aj-sakaler-amontrone-banshi-siksha-1-by-suman-bhattacharya0?ref=clipboard
https://bongodorshon.blogspot.com/2017/08/blog-post.html?m=1
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন